অফিসে সারাদিন অনুপমকে ভীষণ ব্যস্ত থাকতে হয়, তবুও সেই ব্যস্ততার মধ্যেও আজকাল একটা মিষ্টি মুখ এবং সেই মুখের প্রাণ ঠান্ডা করা হাসি বার বার উকি দেয় মনের কোণে। সেই কলেজ জীবনের দিন গুলিই যেন আবার সেজে গুঁজে নতুন করে ফিরে এসেছে তার জীবনে। হারিয়ে যাওয়া সেই দিন গুলি এত দিন নস্টালজিক হয়েই বুকের এক কোনে বাসা বেখেছিল, বাসা বাধেনি বর বলা যায় সযত্বে সে নিজেই ধরে রেখেছিল বুকের মাঝে কিন্তু আজকাল মাঝে মাঝেই মনে হয়, সেই সুন্দর দিন গুলি কোথাও হারিয়ে যায়নি, হারিয়ে যাওয়া কোন দিনই সন্তব নয়। জীবনের সেই সুবর্ণ প্রাণোচ্ছল দিন গুলি, যা হারিয়ে গেলে অক্সিজেনের অভাবে বেঁচে থাকা দুষ্কর হয়ে উঠবে।
সেই সরষ্বতী পুজোর পরে আর রিমার সাথে দেখা হয়নি, সপ্তাহ খানেক পরে একদিন তাকে কার্শিয়াং যেতে হয়েছিল একা একা জিপ নিয়ে। পথের পাশে রিমাকে দেখেই বুকের মধ্যে আবার খুশির ঝিলিক দেখা দেয়। বোধহয় গাড়ির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল সে পথের পাশে, সাজ গোজ দেখে নে হচ্ছিল দূরে কোথাও যাবে হয়তো! অনুপম ওর কাছে এসে দাঁড়াতে চোখে চোখ পড়তেই আবার সেই মিষ্টি হাসি ফুটে উঠেছিল তার ঠোঁটের কোণে। শুনতে পায় তাকে যেতে হবে কার্শিয়াং ছাড়িয়ে দিলারাম ফটক নামক স্থানে, কাজের তাড়া অথচ সেই থেকে কোন গাড়ির দেখা নেই। অনুপম জানায় ওই পথ দিয়েই তাকে যেতে হচ্ছে কার্শিয়াং ডিভিশনের অফিসে, ফলে তাকে পৌছে দিতে কোন অসুবিধে নেই, অবশ্য তার যদি এতটা পথ এক সাথে যেতে আপত্তি না থাকে। অনুপমের কথা শুনে লাজুক হাসি দেখা দেয় মিষ্টি মুখটিতে, মাথা নত হয় রিমার। ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে উঠে তার পাশে বসতে আর দেরি হয়নি।
আজ বেশ রৌদ্রজুল দিন, সকালের দিকে ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন ছিল কিন্তু বেলা বাড়ার সাথে সাথে সমস্ত প্রকৃতি পরিষ্কার হয়ে ঘন নীল আকাশের বুক চিড়ে রোদ ওঠে। সারা পথটা আজ দুজনের কথা বলতে বলতেই কেটে যায়। পাহাড়ি পথে গাড়ি চালাতে আগে বেশ ভয়ই পেতো অনুপম, কিন্তু এখন বেশ ভালো লাগে। পাহাড়ি আকা বাঁকা পথে স্টিয়ারিং এ হাত রেখে বার বার চোখ চলে যায় সুন্দরীর দিকে। আবার আজ তীব্র ভাবে সেই ভালো লাগা অনুভুতিটাই জেগে ওঠে মনে। রিমাও আজ বেশ হেসে হেসে কথা বলছে, কথা বলতে গিয়ে কারণে অকারণে হাসা মেয়েটির ভাব, বুঝতে পারে অনুপম, এতে তার স্বচ্ছ ও পরিষ্কার মনেরই পরিচয় পাওয়া যায়।
কখোপকথনে কত তাড়াতাড়ি গন্তব্য এসে পৌছায়। দিলারাম স্টপেজে নেমে যাওয়ার আগে মিষ্টি হাসি হেসে আরেকবার ধন্যবাদ জানাতে ভোলে না মেয়েটা। গাড়ি সাইড করিয়ে অনুপম নামে, পাশের চায়ের স্টল থেকে দু ভাড় চা নিয়ে খেতে খেতে আরো কিছুক্ষন কথা হয়। অনুপম জানতে চায় কখন ফিরবে সে? ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই জানায় রিমা। কাজ শেষে অনুপম তাকে অপেক্ষণ করতে বলে সেখানেই, আজ দুজনের মধ্যে ফোন নম্বর আদান প্রদান হয়। অনুপম আরো জানায় তার কাজ শেষ হতেও ওই সময় টুকুই লাগবে, তার বেশি নয়। রিমার কাজ শেষ হলে সে ফোন করে জানালেই রওনা দেবে অনুপম এবং এখান থেকেই রিমা উঠে পড়তে পারবে গাড়িতে। কৃতজ্ঞতায় মাথা নত হয় রিমার, সম্মত হয়ে অভ্যাস বশত ঘাড় কাত করে বাধ্য মেয়ের মতোই বলে.... তিক আছে, তাই হবে স্যার। কথাটা শেষ হতেই হেসে বাধা দেয় অনুপম, খুব কাছে এসে জানায়... “স্যর নয়, আমার নাম অনুপম। রিমা আরো লজ্জা পেয়ে এবার রিনরিনে বিনীত স্বরে উত্তর দেয়... “আচ্ছা ঠিক আছে, তাই হবে স্যার । হাসতে হাসতে বিদায় নিয়ে দিলারাম থেকে ডান দিকের রাত্তা ধরে অনুপম।
রাস্তাটা কিছুদুর গিয়ে খাড়া ওপরের দিকে যেন আকাশে উঠেছে। বড় খাড়াই রাভা, প্রথম আর দ্বিতীয় নম্বর গিয়ারে এজেলটর পায়ে জোরে চেপে ধরে খুব ধীরে ধীরে এগোতে হয়, ইঞ্জীনের বিকট গো... গোঁ শব্দ করতে করতে জিপ এগিয়ে চলে। একটু এদিক ওদিক হলেই গাড়ি সমেত সোজা হাজার ফুট গভীর খাদে। এই রাস্তায় এর আগেও বার কয়েক এসেছে সে। রাস্তার দুপাশে বড় বড় বনস্পতি ধুপি গাছের সারি। বনস্পতির মাথা গুলি যেন সোজা নীল আকাশে গিয়ে ঠেকেছে, বড় সুন্দর জায়গাটা। অনেকটা ওপরে উঠে এসে বাঁ দিকে বন জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ি গ্রাম বাগোড়া, বেশি উচ্চতা এবং যথেষ্ট বৃষ্টিপাতের কারণে আবহাওয়া সব সময় স্যাঁতস্যাতে। বাগোড়া গ্রামকে বাঁয়ে ফেলে রেখে ডান দিকের সোজা পথ চলে গেছে ডাউ হিলের দিকে, সেখানেই গন্তব্য তার। ডাউ হিল রেঞ্জে এসে কাজ মিটে যায় ঘন্টা খানেকের মধ্যেই।
এর পর অপেক্ষা করে থাকে রিমার ফোনের। সে কথা দিয়েছে কাজ শেষ হলেই ফোন করে জানাবে, তার ফোন এলেই রওনা হতে হবে, তার আগে নয়। আজ এত দূর রাস্তা তাকে ছাড়া যেতে কিছুতেই মন চাইছে না। ডাউ হিলের রেঞ্জার বাবুর সাথে গল্প করতে করতে চা খেতে হয় দুবার, দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে পকেটের মোবাইল ফোনের দিকে। মনে প্রশ্ন জাগে, ফোন করবে তো রিমা?
ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ বেজে ওঠে ফোন, হাতে নিয়ে ধরতেই সেই মিষ্টি রিনরিনে লাজুক গলা... আমি রিমা বলছি)। আমার কাজ শেষ হয়েছে, আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছি? অভিভূত অনুপম যেন উত্তর দিতে ভুলে যায় প্রথমে, সুন্দরী তরুণী তার অপেক্ষায়? পরে সেও উত্তর দেয়...ঠিক আছে তুমি ওখানেই অপেক্ষা করো, আমি কিছুক্ষনের মধ্যেই আসছি। ঠিক আছে, আমি এখানেই অপেক্ষা করছি স্যার বলেই ফোন রাখে রিমা। আর দেরি করার কারন নেই, চড়াইয়ের পথ বেয়ে নামতে আজ খুব বেশি দেরি হয়নি, 'দিলারামের কাছে এসে দূর থেকে রিমাকে তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বহুদিন আগের একটা অদ্ভুত ভালো লাগা অনুভূতি আবার মনে জাগতে শুরু করেছে অনুপমের। কাছে আসতেই আবার সেই মিষ্টি হেসে পাশে এসে বসে রিমা, আবার গন্প করতে করতে পথ চলা।
এক স্থানে গাড়ি দাড় করাতে হয় সুন্দরীর অনুরোধে। পথের পাশে নির্ভিত ছায়া বিতানে এসে দাঁড়ায় দুজন। গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে আজ হাত বাড়িয়ে দিতেই সেই নরম তুলতুলে হাতের স্পর্শে অনুপম কিছুটা শিহরিত হলেও রিমার এই সাবলীল ব্যবহার তাকে মুগ্ধ করে। অফিসের কাজে এসেছিল রিমা এত তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরতে পারবে তার ধারণাই ছিল না। এই পাহাড় পর্বতে যাতায়াত ব্যবস্থা সমতলের মতো সহজ নয়। একে তো সরাসরি শেয়ার গাড়ি পাওয়া যায় না, রেক জার্নি করতে হয়, তার ওপর গাড়ির অপেক্ষায় রাসায় দাঁড়িয়ে অনেকটা সময় চলে যায়। তাই গন্তব্যে পোছে ফিরে আসতে সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসে, প্রতিবার খাবার সাথে নিয়েই বেরোতে হয় তাকে। আজ অনুপমের সাথে খুব তাড়াতাড়ি অতি সহজে কাজ সেরে ফিরে এসেছে, পথেই সেই বয়ে আনা খাবার শেষ করতে চায় রিমা, খেতে খেতে বাঙালি বাবুর মুখে নিজের হাতে তৈরি মোমোর প্রশংসাও শুনতে সাধ হয় মনে। গাড়ি থেকে নেমে পাইন গাছের নিচে টিফিন বাটিতে বয়ে আনা মোমো দুজনে ভাগ করে খায়। খেতে খেতে কত কথা হয়, দুজনের মধ্যে আড়ষ্টতা আর লঙ্জা আজ অনেকটাই কমে এসেছে। খাওয়া দাওয়ার পরেও বেশ কিছুক্ষণ দুজনে সেখানে বসেই গল্প করে। অনুপম সিগারেট ধরাতে গিয়ে লাইটার কিছুতেই ধরাতে পারে না। শেষে হতাশ ভাবে রিমার দিকে চাইতেই সে হাসি মুখে এগিয়ে এসে তার হাত থেকে লাইটারটি চেয়ে নিয়ে খুব কম সময়ের মধ্যেই জ্বালিয়ে অবাক করে দেয়। সযত্নে দু হাতে বহ্ছি শিখা আগলে অনুপমের মুখের কাছে ধরে, সহজেই অগ্নি সংযোগ হয় সিগারেটে। রিমার নরম হাতের স্পর্শে আবার শিহরিত হতে হয় তাকে।
আবার চলা শুরু হয়, অনুপমের হাতে হাত দিয়ে আবার তার পাশে এসে বসে রিমা। গ্রামে ঢুকে স্কুলের কাছে গাড়ি দাড় করাতে হয়, রিমা নেমে যেতেই কেন জানি মনটা খারাপ হয়ে যায় আজ। গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির পথ ধরার আগে অনুপমের কাছে এসে দাঁড়ায় সে, আবার মিষ্টি হাসির রেখা দেখা দেয় তার ঠোঁটে... গলা নিচু করে সেই রিনরিনে গলায় তার বিদায় বার্তা... আজ তাহলে আসি, আবার দেখা হবে।
অনুপমের গলায় বিদায়ের মুহর্তে ঠাটার সুর... কিন্তু কবে সেই সুদিন আসবে, কবে দেখা হবে রিমা? লভ্জিত নত মন্তকে অবাক করার মতো উত্তর এবার রিমার মুখে……যেদিন আমাকে দেখতে ইচ্ছে হবে আপনার, যেদিন আপনি দেখা করতে চাইবেন? উত্তর শুনে হতবাক অনুপম হাসি মুখে টা টা দিয়ে আপন পথ ধরে, লজ্জিত নত মন্তকে ফর্সা হাত দু'টি বাড়িয়ে রিমাও তাকে টাটা দেয়। ফেরার পথে সারা রাস্তাটা আজ সুন্দর এক নতুন ভালোলাগা তার সারা মন প্রাণ আচ্ছন্ন করে রাখে।
আজ ঘরে ফিরে নিজেকে বড় ক্লান্ত মনে হয় রিমার। বাঙালি ফরেস্ট অফিসার ভদ্রলোকের সাথে কথা বলতে বড় লজ্জা পেয়েছিল প্রথমে। হাসপাতালে প্রথম যেদিন দেখা হয় কেন জানি তার দিকে চেয়ে মনে হয়েছিল যেন কতদিনের পরিচিত সে, কেন এমন মনে হয়েছিল তখন কোন কারণ খুঁজে পায়নি। কিন্ত এর পর যতবার দেখা হয়েছে বড় ভালো লেগেছে, বড় সুন্দর অনুভূতি জেগেছে মনে। আজ বাঙালি বাবুর ব্যবহারে সে সত্যিই যেন মুগ্ধী। বড় সহজ সরল মানুষটি, শহরের বাবুদের মতো অহংকার আর বাবুয়ানা তার মধ্যে লক্ষ করা যায়নি। দীর্ঘ কুড়ি বছরের জীবনে এত সুন্দর পুরুষ মানুষ নজরে আসেনি রিমার। তার ভদ্রতা, নিরহংকারীতা মন কাড়ে সুন্দরীর। আজ সারাক্ষন তার শেষের বলা কথাটি কানে বাজতে থাকে তার। কিন্ত এও কি সম্ভব? মনে কত আবোল তাবোল ভাবের উদয় হয়, ভাবতে ভালো লাগলেও শেষে আশাহত হওয়ার দুশ্চিন্তা মনে জাগে, তাই চুপ করে এই অবেলায় শুয়ে থাকে বিছানায়। বেশ কিছুক্ষণ পরে বাবার ডাকে জেগে ওঠে।
প্রণীত বাবু স্কুল থেকে ফিরেছেন। এই বুবা অর্থাৎ বাবাই রিমার জীবনের সব। তাকে জন্ম দিয়েই তার মা ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন। ছোট্ট রিমাকে বুক দিয়ে আগলে মানুষ করেছেন প্রণীত বাবু। আত্মীয় জনের হাজার অনুরোধেও রিমার জন্য সৎ মা ঘরে আনেননি। ছোট বেলা থেকে বাবার সব সময়ের সঙ্গী রিমা। ছোট্ট মেয়েটিকে স্কুলে নিয়ে চলে আসতেন মাস্টার মশাই। তিনি ছাত্র পড়াতেন, মেয়ে চুপ করে বাবার কোলে বসে থাকতো। ঘুম পেলে বাবার কোলেই শুয়ে পড়তো। একটু বড় হলে ফুলের ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের সাথে খেলে বেড়াতো। তার পর বাবার স্কুলেই একদিন ভর্তি হতে হয়। প্রাইমারি স্কুল শেষ হলে প্রণীত বাবু মেয়েকে দার্জিলিং এর খ্রিস্টান মিশনারি ফুলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে আসেন। বেশ কিছুদিন হোস্টেলে একা একা বাবাকে ছাড়া কাটাতে হয় মেয়েকে। ছুটিতে অবশ্যই বাবার কাছে চলে আসতো সে, দেখতে দেখতে বড় হয় রিমা। মিশনারি কুলের শৃঙ্খলা তার ভাবের মধ্যে ফুটে ওঠে। বাবাকে এখন মায়ের মতোই যত্র করতে শিখেছে। ছোট বেলায় ছিল প্রণীত বাবুর মেয়ে এখন যেন তার মা। বারো ক্লাস পাস করে স্থায়ী ভাবে গ্রামে বাবার কাছেই ফিরে আসে রিমা। কলেজে ভর্তি হয়ে বিয়ে পাস করার চেষ্টা করেনি সে। বেসরকারি মিশনারি সংস্থায় দু বছরের নার্সিং কোর্স করেছিল কার্শিয়াং থেকে। মিশনারি হাসপাতালে কিছুদিন চাকরিও করেছিল সে, পরে রাজ্যের স্বাস্থ্য বিভাগে গ্রামাঞ্চলের স্বাস্থ্য কেন্দ্র গুলিতে অস্থায়ী স্বাস্থ্য কর্মীর দলে নাম লেখায় এবং আজ বছর দুয়েক সেখানেই আছে। বেতন যথেষ্ট না হলেও স্থায়ী হওয়ার সম্তাবনা থাকায় সর্বোপরি বাড়ির কাছে কর্মস্থল হওয়ায় এখানেই পড়ে আছে, অন্যত্র চাকরির চেষ্টা করেনি ।
নেপালি ডুকপা সম্প্রদায়ের মধ্যে মেয়েদের ছোট বেলাতেই বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু শিক্ষিত শিক্ষক বাবার মেয়ে রিমা নিজেও সে যথেষ্ট শিক্ষিতা, তাই সমাজের কোন অনুশাসন মেয়ের ওপর চাপিয়ে দেননি প্রণীত বাবু। মেয়ের যথেষ্ট বয়স ও বুদ্ধি হলে নিজেদের সম্প্রদায়ে পছন্দ মতো পাত্রের সাথেই বিয়ে হবে মেয়ের, বাবার ধারণা এমনই। মেয়েকে ব্বাধীন ভাবে বড় হতে দিয়েছেন তার স্বাধীনতা খর্ব করতে চাননি। ইদানিং মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে বড্ড চিন্তিত তিনি। যথেষ্ট বড় হয়েছে মেয়ে, মায়ের মতোই রূপের অধিকারিণী।
এই গ্রামে রিমার মায়ের মতো রূপ খুব কম মহিলার ছিল। তার মৃত্যুর এত দিন বাদেও এখনো গ্রামের মধ্যে তার রূপ গুন নিয়ে চর্চা হয়। রিমা সব শুনে চোখের জল ধরে রাখতে পারে না। মাকে চোখে দেখেনি সে কিন্তু মায়ের ছবির সামনে চোখের জল ফেলেছে বহুদিন। প্রণীত বাবু দেখে কষ্ট পান, মেয়ের মাথায় ন্নেহের স্পর্শ বুলিয়ে সান্তনা দেন। কতদিন হয়ে গেল স্ত্রীর মৃত্যুর, কিন্তু এক মুহূর্ত তার কথা না ভেবে তিনি পারেন না। দ্বিতীয় বার বিবাহ এই কারণেই করতে পারেননি।
দিন তো প্রায় শেষের দিকে আর একটি বছর মাত্র চাকরি আছে। চাকরি থাকা কালীন মেয়ের বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল। মেয়ের কাছে সে কথা প্রকাশ করে তিনি কিন্তু বুঝতে পারেন মেয়ের যোগ্য পাত্র তাদের সমাজে পাওয়া মুশকিল। সুন্দরী, রুচি সম্পন্ন শিক্ষিতা মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে অন্য সম্প্রদায় থেকেও খোঁজ করতে আসেন কেউ কেউ। আজকাল সমাজে জাত পাত, সম্প্রদায়ের বাধা অনেক শিথিল হয়েছে। দেখা শোনা চলছে, মেয়ের বিয়ে দিতে খুব বেশি দেরি তিনি করতে চান না। আজ মেয়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে অনেক্ষন চেয়ে ছিলেন বাবা।
সেই সাত দিনের শিশুকে বুকে জড়িয়ে এত বড় করেছেন, মেয়েটা পরের ঘরে চলে যাবে ভাবতেই চোখে জল আসে প্রণীত বাবুর। কিন্তু কষ্ট হলেও মেয়ের বিয়ে তো দিতেই হবে তাকে, মেয়েও যে তার 'বুবা' কে ছেড়ে থাকতে চায় না। বিয়ের প্রসঙ্গ উঠলেই বেঁকে বসে, ঝাঁঝের সঙ্গে উত্তর দেয় ... "আমি দূরে চলে গেলে কে দেখবে তোমায় বলতো? পরে শান্ত হয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে জানায়... না বাবা আমি তোমায় ছেড়ে দূরে যেতে পারবো না। মেয়ের কথা শুনে বাবা হাসেন দুজনের কষ্ট হবে একে অপরকে ছেড়ে থাকতে কিন্ত তবুও সমাজের নিয়মেই চলতে হবে তাকে, সৎ পাত্রস্থ করতেই হবে মেয়ে, নয় তো ওপরে গিয়ে কি জবাব দেবেন স্ত্রীর কাছে, তারও তো সময় প্রায় হয়েই এলো রিমার মায়ের কাছে যাওয়ার, তাকে ছাড়া আর যে ভালোও লাগে না।
আজ অনেক্ষন মেয়েকে ডাকেননি ঘুম থেকে, পরে এই অসময়ে তাকে শুয়ে থাকতে দেখে দুশ্টিন্তা হয় অসুখ করেনি তো মেয়ের? কপালে হাত দিয়ে তার শরীরের উষ্ণতা মাপেন, না...জ্বর জ্বালা হয়নি। শহর থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরে এসে বোধহয় চোখ লেগে এসেছে। রিমা ওঠো এবার, সন্ধ্যে হয়ে এলো যে? বাবার ডাকে ধড়মড় করে জেগে উঠে বসে মেয়ে, সত্যিই তো বেলা পড়ে এসেছে! ব্যত্ত হয়ে বাবার কথার উত্তর দেয় সে.... হ্যাঁ বাবা, এই যে, এই তো উঠেছি আমি।"
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখের এলোমেলো চুল গুলি সরাতে সরাতে নিজের মুখটা অনেকদিন পরে খুব ভালো মতো লক্ষ করে আজ, কাজের তাড়ায় কতদিন সিঙ্গার করা হয়ে ওঠেনি। তবুও নিজেকে আজ যেন তার বড় ভালো লাগে, নিজের মুখের সাথে মায়ের মুখের মিল খুঁজে পায়, সকলে ঠিক কথাই বলে, সে দেখতে একেবারে মায়ের মতো, তার মা যে কিনা এই গ্রামে সব চেয়ে সুন্দরী মহিলা ছিলেন জীবিত কালে। হঠাৎ বাঙালি বাবুর বলা আজ শেষের কথা কটি আবার মনে পড়ে যায়, লজ্জায় দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে সে তখন হেসেই ফেলে হঠাৎ।
একা চুপ চাপ শুয়ে বা বসে থাকলেই শুধু নয় কাজের মাঝেও আজকাল ঘন ঘন রিমার মিষ্টি মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে অনুপমের। মোবাইল নম্বর জানা আছে, মাঝে একদিন ফোন করার অদম্য ইচ্ছেকে বহু কষ্টে দমন করেছে সে। ফোন করেনি কিন্তু ফোন হাতে নিয়ে তার ফোনের আশায় বসেও থেকেছে প্রতিদিন। কিন্ত রিমার ফোন আসেনি, হতাশ হয়েছে অনুপম কিন্তু আশাও ছাড়তে পারেনি।
পরদিন অবসর সময়ে আবার ফোনের দিকে চেয়ে বসে থেকেছে। এখন ঘোর বসন্ত কাল, বৃষ্টি হয়নি আর, আকাশ ঘন নীল। বসন্তের আগুন যেন লেগে রয়েছে বনের প্রতিটা গাছের ডালে আর পাতায়। কত ধরনের নাম না জানা বাহারি রঙের ফুল ফুটে আছে গাছে গাছে। কাজ কম থাকলে এমন মন কেমন করা দিনে একাই বন্দুক কাঁধে ঝুলিয়ে অনুপম বেড়িয়ে পড়ে। বনের মধ্যে হাটতে হাটতে বহুদুর চলে যায় সে গভীর অরণ্যে। অমৃত ছেতরী ওকে এই সময় একা একা ঘুরতে বারণ করে।
এই সময় অর্থাৎ শীতের শেষে বনে ভালুকের উৎপাত বাড়ে, সাথে গার্ড দিতে চায়, কিন্ত মানা করে অনুপম, একাকিত্বের মজা সে আর অন্য কারো সাথে ভাগ করতে পারবে না। কিছুদুর একা একা হেটে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে কোন এক গাছ তলায়, আশেপাশে ছোট ছোট কাটা ঝোপ, বন্য কুলের গাছ। ফল গুলি পেকে লাল হয়ে ঝুলে আছে গাছে। বেশ কিছু কুল পেড়ে পকেটে নিয়ে একটা একটা করে মুখে পুড়ে দেয়, প্রচন্ড মিষ্টি আর সুন্দর গন্ধ কুলের। আরো কয়েকটা পেড়ে পকেটে নিয়ে পাগদন্ডী ধরে পাহাড়ের নিচে নামতে শুরু করে এবার।
বেশ কিছুটা নামতেই পাহাড়ি ঝর্ণা, অনেকটা স্থান জুড়ে শুধু বালি আর বড় বড় পাথর, মাঝ খানে সরু জলস্বোত, পরিষ্কার ষচ্ছ কাঁচের মতো জল দেখে তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে আসে অনুপমের, পেট ভরে ঠান্ডা জল পান করে মন প্রাণ শীতল করে নেয়, তার পরে চুপ করে বসে থাকে একটা মাঝারি শিলা খণ্ডের ওপর। অমৃত ছেত্রী বার বার নিষেধ করেছে এই নদীর কাছাকাছি একা একা বেশিক্ষন না থাকতে, বুনো হাতির দল যে শুধু এখানে জল খেতে আসে তা নয়, আশেপাশেই অবস্থান ওদের, বড় খতরনাক জীব এই অঞ্চলের বুনো হাতি, দলবদ্ধ ভাবে তাড়া করে মানুষ মারে। সে সব কথায় কান দিতে যাওয়ার সময় এখন অনুপমের নয়।
সে পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে এক দৃষ্টে সেদিকে চেয়ে থাকে, আবার আশা জাগে মনে ফোন করবে রিমা, পরে হঠাৎ খেয়াল হয় এখানে কোন নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না, ' তখন নিজের মনেই হেসে পকেটে ঢুকিয়ে রাখে ফোন। কিন্তু ভাবনা চিন্তার জন্য তো কোন মোবাইল টাওয়ারের প্রয়োজন হয় না, তাই অবাক হয়ে তার সাথে কাটানো সেই দিনের কথা ভাবতে শুরু করে। সেই তার অপেক্ষায় বাস স্ট্যান্ডে চুপ করে রিমার অদ্ভূত সুন্দর কায়দায় দাঁড়িয়ে থাকা, নিজে হাতে টিফিন বাটি থেকে মোমো আর চাটনি বের করে সষত্বে তার হাতে তুলে দেওয়া, লাইটার বহু চেষ্টা করেও জ্বালাতে না পেরে যখন সিগারেট ফেলে দিতে উদ্যত হয়েছিল সেদিন, হাসি মুখে তার হাত থেকে লাইটার কেড়ে নিয়ে জ্বালিয়ে মিষ্টি হেসে তার দিকে দু হাত বাড়িয়ে দেওয়া, আর সেই নরম তুলতুলে হাতের স্পর্শে শরীরে তার শিহরণ জেগে ওঠা।
তারও আগে সেই প্রথম দিন তার পায়ে যখন জোকের দল ছেকে ধরেছিল, পরম যত্বে তার পা দুটিকে জোক মুক্ত করে ওষুধ লাগিয়ে দেওয়া। রিমার প্রতি তার এই আকর্ষণ যে শুধু দুদিনের মোহ নয়, এ হলো ভালোবাসা। বুঝতে পারে তার প্রতি তার নিখাদ দুর্বলতা, সত্যিই যেন এ কদিনেই তার প্রেমে পড়ে যাওয়া। এও বুঝতে পারে অনুপম অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্য। নিজের কল্পনার জগতে রিমার মতো এমন নেহময়ী কেউ যেন বিচরণ করে আসছে দীর্ঘাদিন, এতদিন খুঁজেও তার ঠিকানা পায়নি সে, এবার যেন সেই মিষ্টি মনের ঠিকানাই সে পেয়েছে। সারা জীবনের সম্পর্কে জড়ানোর দুরাশা জাগে তার সাথে। কিন্ত ভিনদেশী যুবক অনুপমের সাথে অবাঙালি রিমার কি সারা জীবনের সম্পর্ক পাতানো সম্ভব? হ্যাঁ অবশ্যই সম্ভব ষদি দুজনের মনেই সেই ফুল ফুটে ওঠে, তা ছাড়া আর অন্য কোন পথ খোলা নেই। জীবনের প্রথম নারী সুতপার অভাব একমাত্র রিমার দ্বারাই পুরণ হওয়া সম্ভব।
ভাবতে ভাবতে বেলা বাড়ে তবুও উঠে আসতে মন চায় না। মনে আবার হতাশাও জাগে, কেন ভেবে মরছে সে, কার জন্য ভেবে মরছে; এমন ভাবতে ভাবতেই কোন দিন বাবার সাথে তার কোয়ার্টারে এসে বিয়ের নিমন্ত্রন পত্র দিয়ে যাবে রিমা।
বহুদিন আগে সেই সুতপার মতোই, ঠিক তার মতোই স্বামী আর সংসার নিয়ে ভুলে থাকবে সব কিছু, অনুপমের কথা সুতপাও যেমন মনে রাখেনি সেও মনে রাখবে না, সেই দিনটির কথা রোমন্থন করে যতই আশায় বুক বাধুক সে, রিমার তার কথা ভাবতে বয়েই গেছে। মনটা কেমন যেন বিষিয়ে ওঠে, আর ভাবতে ভালো লাগে না, কিন্ত উঠেও পড়তে পারে না।
হঠাৎ খুব জোরে কারো কণ্ঠষকর কানে আসে, উঠে বসে দেখতে পায় ফরেস্ট গার্ড সুববা দ্রুত গতিতে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। অমৃত ছেত্রী অনেক্ষন তাকে ফিরতে না দেখে বোধহয় খোঁজ করতে পাঠিয়েছেন। অনুপম সুববাকে উদ্দেশ্য করে বলে..... "কি সুববা কোন সমস্যা হয়নি তো? সুববা তখন হাপাচ্ছে, এতদূর বোধহয় ছুটতে ছুটতেই এসেছে সে, জানায় সমস্যা নয়, ছেত্রী দাজুর দুশ্চিন্তা হচ্ছে তাকে নিয়ে তাই দ্রুত পাঠিয়ে দিলেন তাকে।
আরো জানায়, চলুন স্যার, এখানে পদে পদে বিপদ,ভালু, হাতি, চিতা বিপদের কি শেষ আছে, এভাবে আর আসবেন না এখানে একা একা। মনে মনে বলে বোধহয়... "এই বাঙালি বাবুর মাথায় নিশ্চয় সমস্যা আছেঃ বেটা নির্ঘাত মরবে একদিন। অনুপম হাসতে হাসতে সিগারেট ধরায় তার পর সুববাকে সাথে নিয়ে কোয়ার্টারের দিকে পা বাড়ায়। আধা ঘন্টার মধ্যে ফিরে এলে ছেত্রী বাবু চিন্তা মুক্ত হয়।
কিন্ত অফিসে আর বসতে ইচ্ছে হয় না। সুববা আর ছেত্রীর ওপর দায়িত্ব দিয়ে সোজা কোয়ার্টারে এসে পোশাক বদল করে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় অনুপম, বোধ হয় চোখ লেগেই
হয়। বেশ কিছুক্ষন পরে আবার ফোন বেজে ওঠে, এবার রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সেই রিনরিনে মিষ্টি কন্ঠন্বর। ভয় ও লঙ্জা মিশ্রিত স্বর রিমার কণ্ঠে। কি কারণে ফোন করেছিল সদুত্তর দিতে না পারায় লজ্জায় যেন মাটিতে মিশে যেতে চাইছে মেয়েটি। অনুপম স্বাভাবিক হয়ে নেপালি ভাষায় কথা বলতে শুরু করে, জানায় এতদিন পরে তার কথা মনে পড়লো রিমার, তবুও ভালো মনে তো পড়েছে তার?
রিমাও চুপ করে থাকে না, কিছুক্ষন ভেবে নিয়ে সেই একই ভাবে, বোধহয় অভিমানী কণ্ঠেই উত্তর দেয়, প্রথম সেই কিন্তু ফোন করেছে অনুপম নয়। বেশ কিছুক্ষন কথা বলার পরে হঠাৎ আজ বলেই ফেলে অনুপম... "তোমার কথা খুব মনে পড়ে রিমা, তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে আমার। কথাটা শুনে যেন প্রথমে তব হয়ে যায় রিমা, কিছুক্ষন কেউ কোন কথা বলতে পারে না। অনুপম মনে মনে লজ্জিত হয়, এত তাড়াতাড়ি বোধ হয় এত সব কথা বলা ঠিক হলো না, কি ভাবছে রিমা তার সম্পর্কে কে জানে? নিজের ওপর রাগ হতে শুরু করেছে তখন অনুপমের। ঠিক তখনই তাকে অবাক করে দিয়ে লাজুক স্বরে মিষ্টি হাসি, আর আবেগী সুর রিমার গলায় ফুটে ওঠে....অনুপ বাবু!"
আর বোধহয় কথা বলতে পারে না মেয়েটা, আবেগে তার গলার স্বর বুজে আসে, লাইন কেটে যায়। ফোনটা বুকের মধ্যে চেপে ধরে ধপ করে শুয়ে পড়ে আবার অনুপম। সপ্ন না বাস্তব বুঝে উঠতে সময় লেগে যায়, তবুও আজ সমস্ত মন প্রাণ তার ঠান্ডা হয়ে আসে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামদেখা দেয়। শ্রান্তিতে চোখ বুজে আসে অনুপমের, আনন্দের আতিশয্যে এই অবেলায় ঘুমিয়েই পড়ে শেষে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন