সম্পর্ক
লেখকঃ- Motiur Miazi
একই সাথে নষ্টা এবং চরিত্রহীন একটা মেয়েকে বিয়ে করার জন্য ধন্যবাদ।
কে আপনি ?
আপনার বিবাহিত স্ত্রী আনিকাকে জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারবেন কে আমি! ওহ সরি, আনিকাকে কি নাম বলে জিজ্ঞেসা করবেন ? নামটিই তো বলা হলো না। বলবেন, রিফাত ফোন দিয়েছিল।
ফোনে কথা বলা অবস্থায় তুহিনের হাত থেকে মোবাইলটি ফ্লোরে বিছানো কারপেটে পরে পর পর তিনটি ড্রপ খেলো। ঘড়িতে সম্ভবত রাত বারোটা বাজে। অন্যান্য রাত হলে রাত বারোটায় সবাই ঘুমিয়ে যেতো, পুরো বাড়ি হয়ে যেত নিস্তব্ধ। রাতটা অন্যান্য রাতের মতো নয়, তুহিনের বাসর রাত। পুরো বাড়ির কেউ ঘুমায়নি, সবাই ভিন্ন ভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে গল্প করছে। ফ্লোরে কারপেট বিছানো ছিল বলে মোবাইল পরার সামান্য শব্দটি কেউ খেয়াল করেনি। তুহিন ফ্লোর থেকে ফোনটি হাতে নিয়ে দেখলো ফোনটি বন্ধ হয়ে গেছে।
খোকা কি হয়েছে ? কোন সমস্যা!
তুহিনের মা রাবেয়া বেগমের প্রশ্নে তুহিন চমকে উঠলো। ফোনে কথা বলা অবস্থায় তুহিনের হাত থেকে ফোনটি পরে গেছে, এই ব্যাপারটি রাবেয়া বেগমের চোখ এড়ায়নি। তিনি পিছন থেকে ঘুরে তুহিনের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
তুহিন অপ্রস্তুত গলায় বললো, না, মা! তেমন কিছুই হয়নি! ফোনটি হালকা ভাবে ধরা ছিল, তাই হয়তো পরে গেছে। এটা কোন ব্যাপার নয়, রাত বারোটা বেজে গেছে ঘুমাবে না ?
দেখিস না বাড়িতে কতো মেহমান, ঘুম আসবে কিভাবে ? রিতা, নিশি এবং পলিরা ফুল সাজানো কমপ্লিট করে ফেলেছে। তরে যেতে বলেছে, সেটা জানাতেই এসেছি।
তুহিন শীতল গলায় বললো, ঠিক আছে মা আপনি ঘুমিয়ে যান, আমি যাচ্ছি। মা যেতেই তুহিন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। তুহিনের রুমটা দু'তলায়, তুহিন সিঁড়িতে পা রাখতেই একবার মনে হলো, অপরিচিত নাম্বারে আসা ফোনটির ব্যাপারে মাকে জানানো উচিত। জানালে মা কি মনে করবে ? কষ্ট পাবে নাতো, খুব কষ্ট! মাকে জানানো হলো না। দু'তলা বেয়ে উপরে উঠার সিঁড়ির সাথেই দুটি টপ রয়েছে। দুটি টপেই পাতাবাহার গাছ লাগানো। লাইটিং এর কারণে টপগুলো অসম্ভব সুন্দর লাগছে। তুহিন সিঁড়ি বেয়ে দু'তলার এসে সোজা নিজের রুমে ডুকল।
গোলাপ ফুলের ঘ্রান আসছে, কড়া ঘ্রান। গোলাপের ঘ্রান এতো কড়া হতে পারে তুহিনের তা জানা ছিল না। পুরু রুমটায় গোলাপ ছাড়া ও গাদা, টগর, লিলি ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। আশ্চর্য গোলাপের কড়া ঘ্রানে অন্য ফুলগুলোকে ঘ্রানহীন মনে হচ্ছে! গাদা ফুলের মালাগুলো খাটের চারদিকে এমনভাবে সাজিয়েছে খাটে বসে থাকা আনিকার ঘোমটা দেওয়া মাথাটি ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না!
আনিকা তুহিনের উপস্থিতি টের পেয়ে সামনের দিকে ঘুরে বসলো। ঘুরতেই মাথার ঘোমটাটা সরে গেলো। তুহিন আনিকার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো।আনিকাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে, মাঝরাতে আকাশের আবছাগুলো সরে গিয়ে হঠাৎ হঠাৎ চাঁদটি দেখা গেলে যে'রকম সুন্দর লাগে সে'রকম সুন্দর। আনিকাকে এতোটা সুন্দর লাগছে কেন ? হয়তো বাসর রাতই পৃথিবীর একমাত্র রাত, যে রাতে চোখের দৃষ্টিভঙ্গি নিজে থেকেই সবকিছু সৌন্দর্যমন্ডিত করে তোলে। তুহিন আনিকার চোখের দিকে মুগ্ধতার দৃষ্টিতে তাকালো। বাসর রাতে স্বামী তার স্ত্রীর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, দৃশ্যটি ছবির মতোই সুন্দর।
তুহিনের চোখ ফিরাতে ইচ্ছে করছে না। কোন মেয়ের প্রতি তুহিনের আগে কখনো এমনটা অনুভব হয়নি। নিশি তুহিনের বেষ্ট ফ্রেন্ড, অথচ তুহিন নিশির চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারে না। গত বুধবার নিশির বার্থ-ডে ছিল। বার্থ-ডে প্রোগ্রামের শুরুতেই নিশির ফ্রেন্ড সার্কেল সবাই এসেছে শুধু তুহিন আসেনি! তুহিনের দূর সম্পর্কের এক খালাতো ভাইয়ের জরুরি রক্তের প্রয়োজন ছিল। তুহিন রক্ত দিতে যাওয়ায় বার্থ-ডে প্রোগ্রামে ঠিক সময়ে উপস্থিত হতে পারেনি। বার্থ-ডে প্রোগ্রামে প্রথমেই তুহিনকে না দেখে নিশি সামান্য রাগ করলো, যখন ফোন দিয়ে তুহিনের ফোন বন্ধ পেলো তখন রাগের মাত্রা বহুগুনে বেড়ে গেলো।
তুহিন রক্ত দেওয়া শেষ করে বার্থ-ডে প্রোগ্রামে উপস্থিত হলো , যখন হলো তখন প্রোগ্রাম শেষ পর্যায়ে। প্রোগ্রামে নিশির ফ্রেন্ড সার্কেল ছাড়া ও নিকট আত্নীয় সবাই এসেছে। মানুষ জনের কারণে বাসার ড্রয়িং রুমে ভিড় লেগে আছে। তুহিন ভিড় ঠেলে নিশির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নিশি কঠিন গলায় বললো, প্রোগ্রামে আসছিস কেন ? আমি তর কে ?
নিশি শুনো......
কি শুনবো আমি ? আমাকে শুনতে হবে না। সত্যি করে বল তুই প্রোগ্রামের তারিখই ভুলে গিয়েছিলি কিনা ?
নিশির রাগ বহুগুনে বেড়ে গেছে। বার্থ-ডে প্রোগ্রামে আসা সকল মেহমানদের সামনেই সে তুহিনের সাথে চেঁচামেচি করছে। অন্য সময় হলে তুহিন চুপ করে থাকতো। এখন চুপ করে থাকার সময় নয়, চুপ করে থাকলে রাগের মাত্রা আরো বেড়ে যাবে। নিশির রাগ ভাঙ্গানোর জন্য সত্যিটা জানানো দরকার। তুহিন মাথা নিচু করে শীতল গলায় বললো, নিশি মানবতার কল্যানে আমাকে ছুটে যেতে হয়েছে, একজন রোগীর চেয়ে তোমার বার্থ-ডে প্রোগ্রামটি নিশ্চয় বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়!
তুহিনের কথা শুনে নিশি সাথে সাথে চেঁচামিচি থামিয়ে দিলো। নিশি একবার তুহিনের দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার নিচের দিকে। প্রোগ্রামে আসা সব মানুষের মাঝে মুহূর্তে নিরবতা চলে এসেছে। নিশি ক্ষাণিক সময় নিরব থেকে বললো, ঠিক আছে, মানছি তর কোন দোষ নেই। কিন্তু...
কিন্তুু কি ?
নিশি থেমে থেমে বললো, তুই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দিকে তাকাতে লজ্জা পাচ্ছিস কেন ? আমি কি তর অপরিচিত কেউ ? অপরিচিত মানুষেরা ও তো কথা বলার সময় একজন অপরজনের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে। কি বলে না ? নাকি মিথ্যা বললাম ? সবসময় খেয়াল করেছি তুই আমার সামনে আসলেই মাথা নিচু করে কথা বলিস। কারণটা কি জানতে পারি ?
সেদিন নিশির কথা শুনে তুহিন তার মাথা আগের চেয়ে ও বেশি নিচু করে ফেলেছিল। তুহিনের ভেতর অস্বস্তি তৈরি হয়েছিল। কিন্তুু আজকে আনিকার চোখের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে তার অস্বস্তি লাগছে না। আনিকাকে পৃথিবীর অন্য দশটি মেয়ের মতো মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে হাজার বছরের পরিচিত একজন আপন মানুষ বিছানায় বসে আছে। তুহিন ভাবলো, আনিকা আমার বিবাহিত স্ত্রী। আমার আত্নবিশ্বাস এই মেয়েটি নষ্টা অথবা চরিত্রহীন হতে পারে না।
তুহিনের মনে এক ধরণের সুক্ষ যন্ত্রনা তৈরি হলো। যে ভাবনাগুলো যন্ত্রনা তৈরি করছে সেগুলো হলো - অপরিচিত নাম্বারে ফোন দিয়ে যে লোকটি নিজকে রিফাত নামে পরিচয় দিয়েছে, লোকটি কি সত্যিই আনিকার পরিচিত ? আনিকাকে জিজ্ঞাসা করা দরকার, কি বলে কথা শুরু করা যায়, নাম জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে। নাম তো জানি, জানলে কি হয়েছে পারিবারিক পছন্দের বিয়ে, সেই হিসেবে মেয়েটি অপরিচিত, নাম জিজ্ঞেসা করে কথা শুরু করা যেতেই পারে।
নাম কি তোমার ?
আনিকা চুপ করে আছে। তার চোখে অপেক্ষার সংকেত, আরেকবার জিজ্ঞাসা করলে তবেই নামটি বলবে, তাই অপেক্ষা করছে। তুহিন দ্বিতীয় বারের মতো ক্ষীণ স্বরে বললো, নাম জিজ্ঞেসা করেছিলাম, জানতে পারি ?
আ-নি -কা, শব্দটি বলতে গিয়ে গলার স্বর আটকে গেল। তুহিন বললো, তুমি কি কোন কারণে ভয় পাচ্ছো ?
আনিকা বললো, হুম।
আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছো ? নাকি অন্য কোন কারণ আছে ?
জানি না! তুহিন বললো, ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই, আমাদের দু'জনের মাঝে সম্পর্ক হলো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। এর মাঝে ভয়ের সম্পর্ক থাকে না, থাকে অধীকার এবং ভালবাসা সম্পর্ক।
আনিকা মাথা নিচু করে তুহিনের কথা শুনছে। তুহিন সামান্য কিছু কথা বলেই ঘেমে গেলো। কিছুক্ষণ থেমে থেকে বললো, স্বামী হিসেবে স্ত্রীর ভালবাসা এবং সর্বোচ্চ অধীকারের স্বাধীনতা তুমি সবসময় পাবে। তুমি নিজকে স্বাধীন মনে অজানা কিছু জানতে চাইলে প্রশ্ন করতে পারো, আমার কাছে তোমার সকল কথা বিন্দু মাত্র টেনশন ছাড়াই শেয়ার করতে পারো. . . . . . . .
বিয়ের আগে মেয়েরা যতোই সাহসী এবং চঞ্চল প্রকৃতির হউক না কেন, বাসর রাতে মেয়েদের চরিত্রের বিপরীত বৈশিষ্ট ফুটে উঠে। প্রতিটা মেয়ের মনের ভেতর এক ধরণের অস্থিরতা এবং ভয় কাজ করে। তবে আনিকাকে দেখে বুঝা যাচ্ছে তার ভেতরের অস্থিরতাটা দূর হয়ে গেছে। আনিকা সহজ গলায় বললো, আপনার কপাল বেয়ে ঘাম পরছে, আর আপনাকে এতোটা চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন ?
তুহিনের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। তুহিন বুঝতে পারেনি। সে সামান্য লজ্জা পেয়ে কপালের ঘাম মুছে বললো -- না, খুব বেশি চিন্তিত নই, তবে....
আনিকা আগ্রহ নিয়ে বললো, তবে কি ?
তুহিন মোবাইলের পাওয়ার বাটন অন করলো। মোবাইলটি অন হতে পুরো এক মিনিট লাগলো। এই এক মিনিট তুহিন ফোনটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মোবাইলটি অন হওয়ার সাথে সাথে আনিকাকে বললো, দেখো তো ফোন নাম্বারটি চিনতে পারো কিনা ?
না, কার নাম্বার ? আমাকে কেন দেখাচ্ছেন ?
ঠিক আছে, নামটি বলছি। নামটি পরিচিত হলে নাম বলার সাথে সাথেই চিনতে পারার কথা। রিফাত নামের একটি ছেলে ফোন দিয়েছিল। আনিকা সত্যি করে বলো রিফাতের সাথে তোমার কিসের সম্পর্ক ?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন