বৃহস্পতিবার, মে ১৬

ডায়েরীর পাতায় তুর্য-পরী



ডায়েরীর পাতায় তুর্য-পরী

মুন্নি আক্তার প্রিয়া


তুর্যর ভাবসাব খুব একটা সুবিধার লাগছে না আমার। হুট করে কেমন যেন চুপ হয়ে গেছে। তার চুপ হয়ে যাওয়া নিয়ে আমার বিশেষ কোনো মাথা ব্যথা নেই। আমার মাথা ব্যথা হচ্ছে,আমারই মনের ভেতর ঘুরপাক খাওয়া প্রশ্নগুলো নিয়ে।


আমি তুর্যকে হারে হারে চিনি। হুটহাট এমন চুপসে যাওয়ার মতো ছেলে তো সে নয়। নির্ঘাত মনে মনে কোনো ফন্দি এটে রেখেছে। আমি জানি, সে আস্ত একটা ফন্দিবাজ!


'এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?' হঠাৎ করে প্রশ্নটি করায় আমি একটু ঘাবড়ে যাই। তুর্য নিশ্চয়ই খেয়াল করেছে, আমি এতক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।


আমি জায়ানের টিশার্ট হাতে তুলে নিয়ে বললাম,'কোথায়? বেশি দেখেন আপনি '

'বেশি কেন দেখব? আমি ঠিক-ই দেখেছি। তোমার মতো আমার চশমা লাগে না। চশমা ছাড়াই আমি স্পষ্ট ক্লিয়ার সব দেখতে পাই।'

'সমস্যা কি আপনার? এভাবে অপমান করে কথা বলছেন কেন?'

'অপবাদ দিচ্ছ কেন? সত্যি কথা মানতে খুব কষ্ট না?'

'ধ্যাত!' বিরক্ত হয়ে আমি বেরিয়ে গেলাম তুর্যর রুম থেকে। অযথা ঝগড়া করার মুড নেই আমার।



তুর্যর সাথে বিয়েটা আমার এখনো হয়নি। মাত্র পড়ছি অনার্স প্রথম বর্ষে। তুর্যর এক কথা, এত বাচ্চা মেয়ে সে বিয়ে করবে না। আচ্ছা এটা বলুন তো, ১৮ বছরের একটা মেয়ে বাচ্চা হয় কীভাবে?


সে যাক, আমাদের বিয়েটা হবে আমার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষার পরে কিংবা মাঝামাঝি। আজ অনেকদিন বাদে ওদের বাসায় এসেছি কারণ ননদ এসেছে বেড়াতে। ননদের দু ছেলে তুর্যর জান। আমিও কিন্তু দুজনকে কম ভালোবাসি না। অনেক অনেক ভালোবাসি। ওদের টানেই হঠাৎ আমার এই বাড়িতে আসা। তবে আমি তো এটাই বুঝতে পারছি না, তুর্য আমার সাথে এমন ব্যবহার কেন করছে?



আপাতত তার চিন্তা-ভাবনা বাদ দিয়ে ছাদে ননদের ছেলেদের নিয়ে কানামাছি খেলছিলাম। চারপাশে রেলিং ছিল বলে, পড়ে যাওয়ার ভয়টা নেই। হুট করে দুজনের কথা বলার শব্দ পাচ্ছি না। ভয় পেয়ে চোখ থেকে কাপড় সরানোর পর দেখতে পাই প্যান্টের পকেটে দু'হাত ঢুকিয়ে তুর্য দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার চোখেমুখে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছিল। ভয়ে বার দু'য়েক ঢোক গিললাম আমি। এখন আবার রাগ করার কী হলো? বাচ্চাদের নিয়ে ছাদে কানামাছি খেলছিলাম বলে নাকি?



আমি কিছু বলার পূর্বে সে তড়িৎবেগে আমার কাছে ছুটে আসে। আমায় দেয়ালের সাথে মিশিয়ে দাঁড় করায়। তার হৃষ্টপুষ্ট হাত দিয়ে আমার গলা চেপে ধরে। একবার তো মনে হয়েছিল, এটাই আমার জীবনের শেষ দিন। তাই বলে যাকে ভালোবাসি তার হাতেই মরতে হবে? তাও আবার বিনা অপরাধে! হায় আল্লাহ্! এ দিনটা দেখার আগেই মরণ হলে তো ঢের ভালো হতো। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম তার হাত আলগা হয়েছে। সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,'তোমার সাথে ঐ ছেলে ছিল কেন?'



আমি হতভম্বের ন্যায় প্রশ্ন করি,'কোন ছেলে?'


'নাটক করবা না। কার সাথে তুমি আজ আমার বাড়িতে আসছ। আমি বিজি ছিলাম বলে তোমায় আনতে যেতে পারিনি। বলেছিলাম, ড্রাইভারকে গাড়ি নিয়ে পাঠিয়ে দেই। তুমি শুনলে না আমার কথা। কেন শোনোনি? ঐ ছেলের সাথে আসবে বলে?'



আমি অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। আসলে তৎক্ষণাৎ কিছু বলার জন্য কোনো শব্দ আমার মস্তিষ্ক ধারণ করতে পারছিল না। আমি কোনো রকমে তার হাত ছাড়িয়ে বললাম,'না জেনে এমন করেন কেন? ও আমার স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড। এ দিকটাতে আসছিল তাই দুজনে একসাথেই এসেছি।'


তুর্য আবারও আমার গলা চেপে ধরে বলল,'তাও তুমি কেন আসবে ওর সাথে? মেরে ফেলি এখন?'


আমার সত্যিই আর তখন কিছু বলার ছিল না। আমি এক প্রকার প্রায় প্রস্তুতই ছিলাম তার হাতে মরার জন্য। তখন সে আমায় অবাক করে দিয়ে হনহন করে নেমে যায় ছাদ থেকে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে ধাতস্থ করে আমিও ছাদ থেকে নেমে যাই।


নিচে আসার পর আপু মানে আমার ননদ জিজ্ঞেস করে,'কী হয়েছে? মন খারাপ নাকি?'


আমি হেসে বললাম,'না আপু।'


রাতে না খেয়ে আপু বাড়িতে ফিরতে দেবে না বলে আমায়ও রান্নার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। জায়ান, রাফি আর জিয়াদের সাথে আমি ফোনে লুডু খেলছিলাম। রাফি আমার অন্য ননোদের ছেলে। তখন রুমে প্রবেশ করে সাক্ষাৎ যমরাজ। থুক্কু তুর্য! আবারও ভয়ে আমার জান যায় যায় অবস্থা। আমি তো কিছু করিনি। তাহলে?


সে জিয়াদ, রাফি এবং জায়ানের উদ্দেশ্যে বলল,'তোমরা বাইরে যাও তো। তোমাদের মাম্মামের সাথে আমার কথা আছে।'


আমি খপ করে ওদের হাত আমার দু'হাতে চেপে ধরে বললাম,'না, ওরা কোথাও যাবে না। আমার সাথেই থাকবে।'

তার চোখ গরম করে তাকানোতে আমার কলিজা ঠান্ডা হয়ে যায়। বাচ্চারাও ভয়ে বেরিয়ে যায়। আমি ভয়ে ভয়ে মুখটা কাঁদোকাঁদো বানিয়ে বললাম,'বিশ্বাস করুন, আমি আর কিচ্ছু করিনি।'


সে আমার দিকে এগিয়ে আসছিল। আজ বুঝি আর রক্ষে নেই। ভয়ে চোখমুখ বুজে বিড়বিড় করে বলছিলাম,'লা হাওলা ওয়ালা...'


তখন তার মুখে শুনতে পাই,'স্যরি।'


আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তার দিকে তাকাই। সে আমার হাত ধরে বলে,'তখন মিজবিহেভ করার জন্য আমি সত্যিই স্যরি। আমি জানি, তোমার অন্য কারো সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। তোমার ওপর বিশ্বাস আছে আমার। তবুও কেন জানি, তোমার পাশে আমি ঐ ছেলেকে মানতে পারছিলাম না। এমনকি অন্য কোনো ছেলেকেই আমি তোমার পাশে সহ্য করতে পারি না।'


আমার ভয় উবে গেল। তবুও একটু ভাবসাব নিয়ে বললাম,'ঠিকাছে। এবারের মতো মাফ করে দিলাম।'


সে হেসে ফেলে আমার কথা বলার ভঙ্গিতে।


রাতে সবাই একসাথে খেতে বসেছি। খাওয়ার সাথে কথা বলার টপিকও হচ্ছে খাবার। কে কোন কোন খাবার এখনো খায়নি, কার কোন খাবার পছন্দ এসব। তো ঐ সময়ে আমি তুর্যকে জিজ্ঞেস করলাম,
'আপনি অক্টোপাস খান?'
তার উত্তর,'হ্যাঁ। তুমি?'
আমি নাক-মুখ কুঁচকে বললাম,'ছি! না। ইয়াক।'
সে একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল,'গরুর ভুড়ি খাও?'
আমি খুশিতে গদগদ হয়ে বললাম,'হ্যাঁ। আমার খুব-ই প্রিয়।'
সে সঙ্গে সঙ্গে বলল,'ছিছিছি, ইয়াক ইয়াক! ওয়াক, ওয়াক!'

মানে এমন একটা অবস্থা সে পারলে এখনই বমি করে ফেলে। খাচ্চোর একটা! শেষে হলো কি, সে তো করল বমি করার অভিনয় কিন্তু আমি সত্যি সত্যিই বমি করে ফেললাম। দু'হাতে মুখ চেপে দৌঁড়ে চলে যাই ওয়াশরুমে। এইযে, সবাই বলে মেয়েরা ঝগড়ুটে হয়। সবসময় মেয়েরা ঝগড়া করে। কথা কিন্তু সত্য নয়। মাঝে মাঝে ছেলেরাও ঝগড়া করে। সেই সাথে ওভার অ্যাক্টিং তো আছেই। যা খেলাম সব বেরিয়ে গেল। ধুর!


এতটুকু লেখার পর ফোনের স্ক্রিনে তুর্যর নামটি ভেসে ওঠে। পরী মুচকি হেসে ডায়েরিটা বন্ধ করে ফোন রিসিভ করে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন