দিনের আলোর তেজ অনেক্ষন আগেই কমে এসেছিল কিন্তু আলোর আভা তখনও জড়িয়ে ছিল বড় বড় বনস্পতির শীর্ষে । অফিস ঘরে বসে এক মনে মাথা নিচুকরে কাজ করে যাচ্ছিল অনুপম । মাস তিনেক আগে বদলি হয়ে এসেছে সে এই রেঞ্জে ।সাত বছরের চাকরি জীবনে বার পাঁচেক বদলি হতে হয়েছে তাকে ,কিন্তু এই লাটপাঞ্চারের মতো এত নির্জন স্থান এই প্রথম ,এই রেঞ্জের ডেপুটি রেঞ্জার সে ।এর আগে শিলিগুড়ির কাছে শুকনা রেঞ্জে থাকতে হয়েছিল এক বছর ,শুকনা পাহাড়ি অঞ্চল নয় সমতল এলাকা ।
তার আগে অবশ্য দার্জিলিংয়ে মাস ছয়েক থেকেছে তবে এত নির্জন স্থান সেগুলো নয় । এখানে অফিসে মোট আট জন কর্মচারী তাকে নিয়ে ,চারজন বন রক্ষী দুজন অফিস পিয়ন আর আছে তার সর্ব সময়ের সহকারী সিনিয়র ফরেস্ট গার্ড অমৃত ছেত্রী । অভিজ্ঞ ব্যক্তি,বন জঙ্গলের অন্ধি সন্ধিতার নখদর্পনে ,বহুদিন আছে সে এই রেঞ্জে বসতি অঞ্চল থেকে বেশ দূরে ,পাহাড়ের ধাপে বেশ কিছুটা সমতল অঞ্চল জুড়ে লাটপাঞ্চার বিট অফিস ,তার এক ধাপ ওপরে ফরেস্ট রেস্ট হাউস ।বনাঞ্চল আধিকারিকরা পরিদর্শনে এসে এখানেই ওঠেন । সেখানে একজন চৈকিদার এবং রাধুনির স্থায়ীপোস্টিং ।বিট অফিস ও রেস্ট হাউসের পুরোটাই কাটা তার দিয়ে ঘেরা ।সাধারণের প্রবেশ নিষেধ সেখানে ।
কিন্তু যারা বাধা নিষেধের তোয়াক্কানা করে মাঝে মাঝেই এ স্থানেহামলা চালায় সেই হাতির ভয়েই এখানে তারের ঘেরা দেওয়া ।বন্য হাতি এই এলাকার ত্রাস তাদের ভয়েই এখানে বন কর্মীরা তটস্থ ।মাঝে মাঝেই চড়াও হয় ,দিব্যিআপন খেয়ালে ভাঙচুর করে চলে যায়,নির্দেশ আছে কোন রকম অনিষ্ঠ করার চেষ্টাকরাও যাবে না তাদের । সসম্মানে শেখানো কায়দায় গভীর বনের পথ দেখিয়ে দিতে হবে সেই দলকে । এত উচ্চতায় হাতির কথা শুনে প্রথমে অবাক হয়েছিল অনুপম এত উচ্চতায় হাতি থাকার কথা নয়।
কিন্তু যেদিন এখানে এসে পৌঁছায় তার পরদিনই বুনো হাতির দল আক্রমণ করেছিল অফিস চত্ত্বর,আধা ঘন্টাউৎপাত চালিয়ে ছিল ছোট বড় মিলে প্রায়বারোটি দাঁতাল । রেস্ট হাউসের সামনে অনেকটা স্থানজুড়ে বেশ সুন্দর বাগান করা রয়েছে , বাহারি ফুল ফোটে সেখানে সারা বছর সেই বাগান তছনছ করে বন কর্মীদের ব্যারাক সেই কাঠের ঘরটির দিকে সদল বলে এগিয়ে যেতে শুরু করেছিল ।তৈরি ছিল কর্মীরা ক্যানেস্ত্রাপিটিয়ে পটকা ফাটিয়ে ,শেষে মশাল.................
খাদ্যবস্তুরঅপ্রতুলতার কারণেই বোধহয় এরা একটু বেশিই হিংস্র।মানুষ মেরে মাটিতে পুঁতে ফেলার খবর অমৃত ছেত্রীর মুখেই শুনতে পায় সে একদিন ।বছর পঞ্চাশ বয়স এই নেপালি ভদ্রলোকের ,দার্জিলিং এর মিরিক অঞ্চলে বাড়ি ।দুজন একই কোয়ার্টারে পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে থাকে । এই বন আর পার্বত্যঅঞ্চলের অনেক গল্প শুনতে পায় অনুপম তার কাছে ।বন কর্মীদের ব্যারাকে সকলের এক সাথেই রান্নাহয়। সন্ধ্যেবেলায় অফিস ঘরে তালা ঝুলিয়ে যখন কোয়ার্টারের বিছানায় এসে কম্বল মুড়িদিয়ে বসে অনুপম ,অমৃত ছেত্রী গরম চায়ের গ্লাস ধরিয়েদেয় তার হাতে ,তার পরে শুরু হয় গল্প। ব্যারাকের রান্নাঘর থেকে কুক লামার ডাল রান্নার সুগন্ধ পাওয়া যায় ।
প্রায় সারা বছর এখানে শীত , দুটো মাত্ৰ ঋতুই তো এখানে শীতকাল আর বর্ষাকাল । শীত যেমন প্রচন্ড বর্ষাওঠিক তেমনই । বর্ষাকালে ঘন সবুজ ঘাসে জোকের বড় উৎপাত ।এখন শীত কাল পুজোর আগে এখানে বদলি হয়ে চলে এসেছে তাই বর্ষার সাথে এখনও পরিচয় হয়নি তার ।বিকেল পাঁচটার মধ্যেই সারা বনভূমি জুড়ে আঁধার নামে ,সাথে হাড় কাঁপানো শীত ।বিট অফিসে দিনের বেলাতেও ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বলে । কোয়ার্টারেও রাতে আগুন জ্বালিয়ে রাখতে হয়। দশটা পাঁচটার আরামের চাকরি নয় তাই সারা রাত সজাগ থাকতে হয় তাদের সকলকেই । যে কোন পরিস্থিতিতে ফরেস্ট গার্ডনৈশ প্রহরীর বাঁশি বেজে উঠলেই তৈরি হয়ে ছুটতে হয় ,শীত কাল হোক অথবা ঘোর বর্ষারাতে সজাগ থাকতে হয় সকলকেই । শুধু বন্যজন্তুর আক্রমণের ভয়েই নয় চোরা শিকারি আর কাঠ চোরদের হাত থেকে জাতীয় সম্পত্তিরক্ষা করাই যে আসল কাজ আর সেই উদ্দেশ্যেই এখানে রেঞ্জ তাদের অফিস এবং মতো বেতনভুক কর্মী নিয়োগ ।
সমতল অঞ্চলের ছেলে অনুপম বনজঙ্গল পাহাড়ের সাথে পরিচয় চাকরির পরেই ।পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় বসেছিল সরকারি কেরানি হওয়ার জন্য ।বন দপ্তরের পরীক্ষায় পাস করে যখন চাকরিটা হয় চাকরি জীবন সম্বন্ধে বিন্দুমাত্রধারণাতার ছিল না । ট্রেনিংকরতে হয়েছিল ডাউ হিলে ,আর তখন থেকেই পরবর্তী জীবন সম্পর্কে ধারণা হয়েছিল বেশ খানিকটা ।ট্রেনিং শেষে আর দক্ষিণ বঙ্গে ফিরে যাওয়া হয়নি ,দার্জিলিং ওয়াইল্ড লাইফ ডিভিশনের নানা স্থানেঘুরে বেড়াতে হয়েছে সেই থেকেই । প্রথম কিছুদিন বন পাহাড় অসহ্য লাগলেও ধীরে ধীরে সয়ে যায় ।
কলকাতার কাছে হুগলির চন্দন নগরে বড় হওয়া অনুপম কি ভাবে যেন বন্ধুবান্ধব আত্মীয় পরিজন ভুলে যায় ধীরে ধীরে । এখন কিন্তুখুব খারাপ লাগে না ।লোকালয় থেকে অনেক দূরে গভীর অরণ্যে একাকী বেশ কাটে তার ।অফিসের কাজ শেষ করে লিখতে বসে ডায়রি ,অনেক রাতে যখন সহকর্মীরা সকলেই বিছানায় অঘোর ঘুমে, বন্দুকটা কাঁধে ঝুলিয়ে কোয়ার্টারের বাইরে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়েথাকে খোলা আকাশের নিচে , বন ভূমির সেই নিস্তব্ধতা বড় ভালো লাগে তার চোখে আরণ্যক উপন্যাসের সত্যচরণের কথা মনে পড়ে ।
এমনই তো জীবন ছিল তারও কলেজের লাইব্রেরি থেকে বইটা নিয়ে এসে প্রথম যখন পড়েছিল অনুপম ,বড় ভালো লেগেছিল ,কিন্তুএমন জীবনই যে লেখা থাকবে তার জন্য কে জানতো ! প্রথম প্রথম বাড়ির কথা , বিধবা মায়ের কথা ,বন্ধুবান্ধবের কথা বড় বেশি করে মনে পড়তো ,এখন মনে পড়লেও মন আর ততোটা হুহু করে না বরঞ্চ ছুটি ছাটায় চন্দন নগরে মায়ের কাছে ফিরে এলে দিন দুয়েক পর থেকেই জঙ্গলের জন্য মন হাঁপিয়ে ওঠে । মাকে নিজের কাছে নিয়ে এলে আর কোন পিছু টান থাকে না ,কিন্তু বাধ সাধে দিদি ।
দিদি স্কুলটিচার , তাদের দুই ভাই বোন আর মাকে ছেড়ে বাবা যখন মারা যান দিদি তখন সবে কলেজ শেষ করে ইউনিভার্সিটিতে , আর অনুপম কলেজে । বাবা ছিলেন স্কুলশিক্ষক , কর্মরত অবস্থায় বাবার মৃত্যুরকারণে দিদি সেই স্কুলেই চাকরি পায় । দিদির বিয়ের বেশ কিছুদিন পরেই বন দপ্তরের কাজে নিযুক্তহয় অনুপম । জামাই বাবু আর দিদি মায়ের কাছেই আছে ,একই স্কুলেচাকরি করে দুজন । তারা কেউই মাকে ছাড়তে চায় না ।বনে বাদারে মাকে নিয়ে আসতেও দেয় না তাই । এভাবেই একা থাকতে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে সে বাড়িতেও আসা যাওয়া হয় কম প্রকৃতির সান্নিধ্যছেড়ে মন যেন আর কোথাও যেতে চায়না এখন ।
লাট পাঞ্চার অরণ্য অঞ্চলের অনতি দূরে আহালদাড়া জনবসতি অঞ্চল চা বাগানের মাঝে একটি ছবির মতো সুন্দর গ্রাম।সেই আহালদাড়া হয়ে কার্শিয়াংখুব কাছে । এই আহালদাড়া আর লাট পাঞ্চারের মাঝে একটি নেপালি জনবসতি ,দুই চার খানা দোকান পাট , ছোট্টএকটা বাজার মতো ।আর আছে একটি প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র ওপ্রাথমিক স্কুল।ফরেস্টের জিপে চড়ে দার্জিলিং অথবা কার্শিয়াংযাওয়ার পথে ওই হাসপাতালের সামনে ইট পাতা রাস্তাদিয়ে মাঝে মাঝেই যেতে আসতে হয় অনুপমকে ।
একদিন আহালদাড়া থেকে জিপ নিয়ে ফেরার পথে জঙ্গলের মধ্যে পাহাড়ি বোলতা কামড় দিয়েছিল অনুপমের ডান হাতে ।প্রচন্ড যন্ত্রনা নিয়ে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে না এসে উপায় ছিল না ।একজন মহিলা এবং দুজন পুরুষ স্বাস্থ্যকর্মী।বিকেল তিনটে নাগাদ তখন স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ হওয়ার সময় ।মহিলা স্বাস্থ্যকর্মী সম্ভবত নার্স যত্ন করে তার হাতে ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়ে ছিলেন এবং সাথে সযত্নে একটি ইঞ্জেকশনও ।অল্প বয়সী বেশ সুশ্রী নেপালি ভাষী নার্স মুখে সব সময় একটা হাসির ছোঁয়া বড় খাতির করেছিল সেদিন অনুপমকে ।
কেন জানি আজ বহুদিন পরে ওই নার্সমেয়েটিকে দেখে নিজের কলেজ জীবনের সুতপার কথা মনে পড়ে যায় তার ।সুতপা তার নিচের ক্লাসে পড়তো ,এক ক্লাস নীচে । কলেজে প্রথম যেদিন তার সাথে পরিচয় হয় তার মুখেও যেন ঠিক এমনি লাজুক হাসি আজও স্পষ্টমনে পড়ে অনুপমের । এর পর ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে, এক সাথে কলেজের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলা সাইকেলে চেপে গঙ্গার ধারে হাওয়া খেতে যাওয়া । রাতে ঘন্টার পর ঘন্টা সুখ স্বপ্নেবিনিদ্ররজনী কাটানো । কতবার মনে হয়েছে কিছু একটা বলা দরকার সুতপাকে , কিন্তুওর সাথে দেখা হলেই আর সে কথা মনে পড়তো না , কিছু যে বলতে হবে ভুলে যেত বেমালুম ।
স্পষ্টবুঝতে পারতো সুতপাও যেন কিছু শুনতে চায় তার মুখ দিয়ে কলেজের নিকট বন্ধুবান্ধব তাকে দেরি করতে নিষেধ করেছিল খুব শিগগির যেন একটা মিষ্টিসম্পর্কের সূচনা আচঁ করেছিল তারাও ।কিন্তুওই একটা কথাই বলার সাহস পায়নি কোন দিন অনুপম । মনে মনে তৈরি হয়ে বলতে গিয়েও যেন বলতে পারেনি । পরে নিজেকে যতই বোকা মনে হোক না কেন " আমি তোমাকে ভালোবাসি " কথাটা বার বার সুতপা ইঙ্গিত দিলেও কিছুতেই মুখ ফোটেনি অনুপমের তাই সম্পর্কটাও আর এগোয়নি , বন্ধুত্বেই থেমে গেছে ।কিন্তুদুজনই দুজনের মনের খবর জানতো , একজন সুযোগ দিয়ে বসে থাকলেও আরেকজন তার সদ্ব্যবহার করতেই পারেনি ।শুতে বসতে যতখানি ভেবেছে বাস্তবেতার এক কনাও হয়ে ওঠেনি । পার্টটুপরীক্ষার বছর খানেক পরে তখন আর কলেজে যেতে হয়না নিয়মিত , দেখা সাক্ষাতও হয়না সুতপার সাথে ,কিন্তুমনের মধ্যে ভাবের ঘোর ছেড়ে এখনো বেড়িয়ে আসতে পারেনি অনুপম ।
কোন এক বসন্তের মন কেমন করা দিনে সুতপা নিজেই এসেছিল তার বাড়িতে । ওকে দেখে অনুপমের মনের অবস্থা তখন কাহিল । ওকে কোথায় বসতে দেবে , কি খেতে দেবে ভেবেই অস্থির ।সুতপা ঘরে এসে বসেছিল তারপর বেশি দেরি না করে এক খানা খাম ধরিয়ে দিয়েছিল তার হাতে । বিয়ের কার্ড, সামনের কোন এক ফাল্গুনী গোধূলি বেলায় সে অন্যের হাতে সমর্পিত হতে চলেছে । সেই শুভ দিনে সকলের সাথে নিমন্ত্রন থাকছে তারও ।কার্ড খানি তার হাতে যত্নকরে তুলে দিয়ে মুখে কিছুই বলতে পারেনি সুতপা ,শুধু হেসেছিল একটু খানি , সেই হাসির অন্তর্নিহিত ভাব তখন বুঝতে পেরেও আর কিছুই করার ছিল না বেচারা অনুপমের ।সেও সেদিন আর বিশেষ কিছু বলতে পারেনি তাকে , এর পর বিদায় নিয়েছিল সুতপা ।ফিরে যাওয়ার আগে হঠাৎ ছল ছল চোখে করুন দৃষ্টিতে চেয়েছিল এত দিনের পরিচিত ধীর স্থিরশান্ত স্বভাবের অনুপমের দিকে । তারও হয়তো কিছু বলার ছিল বোধ হয় কিন্তুসেও তো পারেনি সাহস করে মুখ খুলতে ।
হঠাৎ আজ তার মনে পড়ে যায় সেই ঝড় বাদলার দিনের কথা ।বিকেল বেলায় ঘুরতে বেরিয়েছিল দুজন ,ফেরার পথে ঝড় ওঠে , দিগ্বিদিক লন্ডভন্ড করে ঝড় থেমে এর পরে নামে অঝোরে বৃষ্টি।শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে তখন তারা । একটা পুরনো শিব মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছিল দুজন ঝড় আর বৃষ্টিরহাত থেকে বাঁচতে ।এক সময় ঝড় থেমে যায়,আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি তার সাথে ঘন ঘন বিকট মেঘ গর্জন । মন্দিরের এক কোনে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল সুতপা আরেক কোণে আড়ষ্ট অনুপম । আকাশে বিদ্যুৎচমকানোর সাথে সাথে বিশাল বজ্রপাতের আশঙ্কায় ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিজের অজান্তেই কখন যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বন্ধুর বুকে , তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ভয়ে মুখও লুকিয়েছিল তার বুকে । আর অনুপম কি করবে বুঝতে না পেরে আড়ষ্টতা কাটিয়ে কোন রকমে জড়িয়ে ধরেছিল সঙ্গিনীকে । দুজনের মনের অবস্থা কেমন হয়েছিল তখন সঠিক জানা যায়নি কিন্তু বৃষ্টি থামার অনেক আগেই একে অপরের কোল ছেড়ে দুজনেই মন্দিরের দুই কোনে আবার আড়ষ্ট ভাবে দাঁড়িয়েপড়েছিল ।
এর পর এক সময় বৃষ্টিও থামে কেউ কোন কথা না বলেই ফিরে আসে যে যার ঘরে ,কল্পনায় যা জেগে ওঠে মনে বাস্তবেতার কিছুই হয়ে ওঠেনি , এমন সুন্দর অনুভূতি সম্পুর্নবৃথা কারণ কারো মধ্যেই কোন দুরাশা জেগে ওঠেনি ,ভয় মিশ্রিত লজ্জা তখনও ওরা কাটিয়েই উঠতে পারেনি ।ঘরে ফিরে সারা রাত সেদিন একটুও ঘুমাতে পারেনি সুতপা ।শরীর ও মনের অদ্ভুত অনুভূতির কথা মনেই থেকে গেছে । আশা করেছিল এমন ভালো লাগা অনুভূতির সূত্রধরেই হয়তো সম্পর্কের গতি ত্বরান্বিতহবে কিন্তুতা হয়নি । কিন্তুএতে কারো দোষ দিতে সে পারেনি ,মনে মনে ভেবে দেখেছে , ভালো লাগা ভালো বাসায় পরিণত হয়েই বা কি এমন লাভ হতো ,প্রায়সমবয়সী সহপাঠীদের মধ্যে ভালোবাসার ফুল ফোটে ঠিকই কিন্তুতা পরিণতি লাভ করা যথেষ্টকষ্টসাধ্য ।
কারণ কলেজের পাঠ চুকিয়ে যখন পুরুষ মানুষ এমন এক অনিশ্চিত জগতে প্রবেশ করে ,যখন চাকরি বাকরি বা ভবিষ্যত জীবনে নিশ্চিত রোজগার আর সসম্মানে বেঁচে থাকার চেষ্টাকরতে হয়। ঠিক সেই সময় তারই ভালো লাগা মেয়েটির ক্ষেত্রে তার বাপ মা আত্মীয় পরিজন চেষ্টাকরতে শুরু করে সুনিশ্চিত ভবিষ্যতের অর্থাৎ তাকে যোগ্য পাত্রস্থকরার । কিছু কিছু ক্ষেত্রেব্যতিক্রম ঘটলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেইতো এমনই হয় । সেই ভালোলাগা অনুভুতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোন চেষ্টাকরেনি অনুপম , প্রথম প্রথম তার প্রতিএকটু বিরক্ত যে হয়নি সুতপা তা নয় ফলে এর পরে ধীরে ধীরে নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বেড়েছে , যোগাযোগও কমেছে ।কিন্তুপরে ভেবে দেখেছে এটাই স্বাভাবিক ।
তাই আজ চলে আসার আগে অনুপমের দিকে চেয়ে বুকটা তার শূন্যহয়ে এসেছিল আজও মুখে কিছুই বলতে পারেনি , শুধু একটা কথাই তার মনে জেগেছিল বার বার... "ঢেউ দিয়ে দিয়ে নদী ভাঙে যদি কূল ,বালুকার বাঁধ দেওয়া সেখানে যে ভুল.....।"নির্দিষ্ট দিনে সুতপার সাথে দেখা করে এসেছিল অনুপম ,বধূ বেশে বান্ধবীকে দেখে মনের ভেতরে হারিয়ে যাওয়া গল্পটা বেজে উঠতেই বুকের কাছটা হঠাৎ চিন চিন করে উঠেছিল তার তবুও মেহেন্দি রাঙা হাতে উপহার ধরিয়ে ভবিষ্যৎ জীবনের শুভেচ্ছা জানিয়েও এসেছিল তাকে ,কিন্তু খাওয়ার পাতে কিছুতেই বসতে পারেনি অনুপম । রাতে অনেক্ষন জেগে ছিল সেদিন সুতপার বিয়ের সানাইয়ের সুর তার কানে তখনও যেন বেজে চলেছিল । বিনিদ্রচোখে হতাশার সুর ফুটে উঠেছিল তার মনে ....." যে কথা মনের কথা জানি না কেন ,মুখে এসে থেমে গেল বলা হলো না....বলা গেল না .....।"
এর পর সুতপার সাথে আর কোন দিন দেখা হয়নি অনুপমের । তবে তার কথা মনে পড়লেই এখন নিজেকে বড় অসহায় মনে হয় তার ।বার বার মনে হয় যেন ওর সাথে সেই মিষ্টি সম্পর্কটা ফুটিয়ে তোলার কোন আগ্রহই সে দেখায়নি । চেষ্টাকরলে অপর দিক থেকে ইতিবাচক উত্তরই বোধহয় তার জন্য অপেক্ষা করে বসে ছিল । কিন্তু ওসব ভেবে আর কি হবে ,সেদিনও আর ভাবেনি ,এখনও ভেবে মনের কষ্ট বাড়ানো ছাড়া কোন লাভ হয় না ।
সেবার সুতপার বিয়ের পর থেকেই নিজেকে নিয়ে ব্যস্তহয়ে পড়েছিল সে ।মাস্টার ডিগ্রি করেনি আর , চাকরি বাকরির চেষ্টায় লেগে পড়েছিল আর বছর দুয়েকের মধ্যেই বন দপ্তরের সাথে নিজেকে যুক্ত করতে সমর্থ হয়েছিল । মায়ের মত ছিল না বাড়ি ছেড়ে ,সভ্য জগৎ ছেড়ে বনে বাদারে পড়ে থাকে তার ছেলে । অনুপমেরও প্রথম দিকে তেমন আগ্রহ ছিল না ।কিন্তুপরে ভেবে দেখেছে জীবনে প্রথম জিনিসের মাধুর্য্যই আলাদা । জীবনের প্রথম ভালোবাসা দরজায় কড়া নেড়ে ফিরে গেছে ,শুনেও শোনেনি সে । স্পষ্ট বুঝেছিল প্রথম ভালোবাসা গাছের প্রথম ফলের মতোই মিষ্টি,এর স্বাদের যেন কোন তুলনা নেই । যদি তাই না হবে তবে সেই প্রথম ভালোবাসার ভালো লাগা এখনো কেন মন থেকে সম্পুর্নভুলতে পারে না সে ? তাই জীবনে আর কোন ' প্রথম'কেই সে কোন মতে অবহেলা করতে পারবে না,সুতপা যেমন তার প্রথম ভালোবাসা বন দপ্তরের এই চাকরিও তার প্রথম সাফল্য , তাই একে গ্রহণ করতেই হবে ।
দেখতে দেখতে সাতটা বছর অতিক্রান্ত হয়েছে ।তার প্রথম ভালোবাসা সুতপাও বোধহয় এখন ঘোর সংসারী ছেলে পুলের সংসারের গৃহিনী ।ওকে তো ভুলেই ছিল কিন্তু আজ ওই স্বাস্থ্য কেন্দ্রের নার্স মেয়েটির হাসি ,তার সেই হারিয়ে যাওয়া না ফোটা মিষ্টি সম্পর্কের বহুদিন আগের সেই ভালো লাগা অনুভূতিটাই মনের মধ্যে আবার জাগিয়ে দিয়ে গেছে যেন ।
রাত তখন গভীর ,প্রচুর শীত এখন এখানে ,অনেক রাত পর্যন্তঅফিসে বসে কাজ করে চলেছে অনুপম সঙ্গে অমৃত ছেত্রী। বাইরে বন ভূমি কুয়াশায় আচ্ছন্ন, মাঝে মাঝে বন্য জন্তুহায়না কিম্বাকোন সরীসৃপের হাটা চলা স্পষ্টবোঝা যায় শুকনো পাতার ওপর সর সর শব্দে ।ভারী পায়ের শব্দ নয়,দলবদ্ধ হাঁটাচলা নয় ,তাহলে পাহারারত বন কর্মীদের তীক্ষ্ণ বাঁশির শব্দ সাথে সাথেই কানে আসতো ,আর কানে এলেই তৈরি হয়ে হাতি তাড়াতে ছুটতে হতো । এ সাধারণ কোন প্রাণীর পায়ের শব্দ ,হায়না, শিয়াল বা চিতা ।ঘড়িতে রাত এগারোটা সারা বন ভূমি অনেক আগেই কুয়াশার চাদর গায়ে জড়িয়ে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। অমৃত ছেত্রীআর কাজ করতে দেয় না তাকে । অফিসে তালা ঝোলানোর আগে আর.টিতে কর্তব্যরত রক্ষীদের সাথে কথা বলে নিতে হয় অর্থাৎ অবস্থা স্বাভাবিক কি না জেনে নিতে হয় ।
তার পর কোয়ার্টারে এসে কুক লামার হাতের তৈরি গরম গরম রুটি আর আলু মটরের সব্জী দিয়ে ডিনার সেরে সরাসরি কম্বলের তলায় ।সারাদিন আজ অনেক পরিশ্রম হয়েছে , পাহাড়ি বোলতার কামড়ে আহত ডান হাতের ব্যান্ডেজের ওপর হাত পড়তেই আবার সেই নার্সমেয়েটির কথা তার সেই মিষ্টিহাসি মনে পড়ে যায় ।আর কিছু ভাবতে না চাইলেও একটা অদ্ভুত সুন্দরঅনুভূতি জাগে মনে , যা এই সাত বছরে একবারও মনে জাগেনি ।
ফেব্রুয়ারি মাস পড়ে গেছে , দিন কয়েক আকাশ মেঘলা থাকার কারণে ঠান্ডা কম ছিল কিন্তু দিন দুয়েক অকাল বৃষ্টিতে আবার জাকিয়ে শীত পড়েছে ।রোজ ভোর রাতেই দুয়েক পশলা বৃষ্টি হচ্ছে সকালে আবার রৌদ্রজ্বল দিন ।বনভূমির গাঢ়সবুজ রঙের ঘাস যেন জল পেয়ে আরো ঘন সবুজ রঙ ধারণ করতে শুরু করেছে , শীতের তান্ডবে এতদিন ফ্যাকাশে হয়েছিল বনভুমির সমস্ত গাছপালা ,বসন্তের শুরুতে আবার নতুন পাতা গজাবে গাছে আবার চোখ ধাঁধিয়েযাবে চোখ জুড়ানো সবুজে । এরই মধ্যে লাট পাঞ্চার বিট অঞ্চলে বনের গাছে গাছে বাহারি রঙের ফুল ফুটতে শুরু করে দিয়েছে ।
সেদিন দুপুর বেলায় অফিস ঘরে বসে কাজ করছিল অনুপম , দরজায় পাহারারত বনকর্মী সুব্বা এসে জানায় দুজন দেখা করতে এসেছেন তার সাথে পাশের গ্রাম থেকে । অনুপম তাদের ভেতরে নিয়ে আসার নির্দেশ দিতেই কিছুক্ষনের মধ্যে একজন মধ্যবয়স্ক নেপালী ভদ্রলোক সাথে একজন অল্প বয়সী মহিলা তার সামনে এসে হাত জোড় করে দাঁড়ান। পরিচয় দেন তার নাম প্রণীত ডুকপা তিনি পাশের গ্রাম্য প্রাথমিক স্কুলের হেডমাস্টার ,সঙ্গের মহিলা ওই স্কুলেরই সহ শিক্ষিকা ।অনুপম তাদের প্রতি নমস্কার জানিয়ে বসতে বলে । শুনতে পায় তারা তাকে আমন্ত্রণ জানাতে এসেছেন । সামনের মঙ্গলবার সরস্বতী পূজা , ওই স্কুলেও প্রতিবছর বাগদেবীর আরাধনা করা হয় এবং সন্ধ্যেবেলায় ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নিয়ম মতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও অনুষ্ঠিত হয় আগে যারা এই অফিসে ছিলেন তারা অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত থেকেছেন প্রতি বছর ।হেড মাস্টার অনুরোধ করেন সেই সন্ধ্যের অনুষ্ঠানে অনুপমকে সেখানে উপস্থিত থাকার । অনুপম কথা দেয়, যদি অফিসের প্রয়োজনে ডিভিশনের অফিসে ছুটতে না হয় যদি এখানেই সেদিন সে থাকে তবে অবশ্যই সেখানে উপস্থিত থাকবে ।আরো কিছুক্ষন কথা বলে শিক্ষক শিক্ষিকা বিদায় নেন ।
নির্দিষ্ট দিনে বিকেল বেলায় ডিউটি ইউনিফর্ম ,লংবুট ছেড়ে সাদা পাজামা পাঞ্জাবির সাথে শাল গায়ে চড়িয়ে আর পায়ে চটি জোড়া পড়ে জিপে স্টার্ট দিয়েছিল অনুপম উদ্দেশ্য স্কুলের সরস্বতী পুজোর অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহন করা । স্কুলের কাছে জিপ দাঁড়াতেই ছুটে আসেন সেই হেড মাস্টার মশাই সহ দুজন শিক্ষিকা প্রধানশিক্ষক ভদ্রলোক তার গলায় মাল্যদান করে সাদরে নিয়ে আসেন ভেতরে ।ছাত্র ছাত্রীরা অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে হাত জোড় করে চেয়ে আছে । এত খানি উষ্ণ অভ্যর্থনা আশা করেনি অনুপম ,কেন জানি তার বড্ড অস্বস্তি হচ্ছিল এখানে এসে । ছোট্ট গ্রামখানির লোক সংখ্যাও খুব কম , প্রায়সকলেই জড়ো হয়েছে স্কুলপ্রাঙ্গনে।সরস্বতী প্রতিমার কাছে নিয়ে আসে তাকে সকলে । সব কিছুই বাঙালিদের মতো শুধু প্রতিমার সাইজ অনেকটা ছোট ,দেবীর বাহন সেই রাজ হংস এবং তার বীণা খানিও যথেষ্ট ছোট বাকি সব একই রকম ।
অনুষ্ঠান শুরু হয় বাচ্চা ছেলে মেয়েদের নিয়ে অনুষ্ঠান পরিচালনা করছে যে মহিলা তার দিকে চেয়ে অবাক হয় অনুপম ,স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সেই নার্স মেয়েটি । অনুষ্ঠান শুরুর আগে সেও আজ তার সামনে হাত জোড় করে পরিচয় পর্বসেরে গেছে , সাথে সেই মিষ্টিহাসি , আবার মন উদাস হয়ে যায় অনুপমের । বেশ লাগছে আজ সন্ধ্যেটা এক সময় শেষ হয় অনুষ্ঠান । নুষ্ঠানশেষ হলে সে স্কুলের বাইরে মাঠের কাছে একটু খানি আড়াল করে নিজেকে ,দীর্ঘক্ষন ধূমপান করা হয়নি ,সেই উদ্দেশ্যেই নিজেকে আড়াল করা ।আজ বিকেল থেকে বেশ ঠান্ডাপড়েছে আবার ।কিন্তু বেশিক্ষন সে ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না অনুপম বড্ড মশা কামড়াচ্ছে পায়ে।
সিগারেটে দুয়েকটা লম্বাটান দিয়ে ফিরে এসে দেখে হেড মাস্টার হন্যে হয়ে তাকেই খুঁজছেন ।বাচ্ছারা প্রসাদ খেয়ে দল বেঁধে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে তখন ।প্রণীত বাবু অনুপমকে সাথে করে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন । এখানেই তার খাওয়াদাওয়া আপ্যায়নের ব্যবস্থার কথা শুনে লজ্জিত অনুপম বাধা দিয়েছিল প্রথমে কিন্তুপরে যখন জানতে পারে সেই মিষ্টি হাসির নার্সমেয়েটির বাবা স্বয়ংহেড মাস্টার তখন আর অমত করতে পারেনি সে ।বাপ মেয়ে সাদরে নিজেদের ঘরে নিয়ে আসেন আকে । শীদের কারণে গাসের পাস প্রতিটি বাড়ির টাঠানে দান করা হয়েছে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন