প্রতিদিন অফিসের জন্য রেডি হওয়ার সময় আবির নিজের কোনোকিছুটাই খুঁজে পায় না। তাই পর্নাকেই সব ওর হাতের কাছে সাজিয়ে রাখতে হয়।কিন্তু পর্ণার আজ রান্না বসাতে দেরী হয়েছে।তাই আবিরের অফিসের শার্ট প্যান্ট রুমাল কোনো কিছুই তার আর এক জায়গায় গুছিয়েথেতিয়ে রাখা হয়নি।আবির বাথরুম থেকে বেরিয়ে টাওয়েল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বেডরুমে এসে কোনো কিছুই প্রতিদিনের মত হাতের সামনে না পেয়ে পর্ণাকে হাঁক দিলো-
-পর্ণা..এই পর্ণা..আমার শার্ট প্যান্ট গুলো কোথায়?
পর্ণা রান্নাঘর থেকে আবিরের গলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে
-আরে আলনায় দেখোনা।ওখানেই তো থাকার কথা।
আবির আলনায় প্যান্টটা পেলেও ওর পছন্দের নীল রঙের শার্টটা আর খুঁজে পেলোনা।তাই সে ফের পর্ণাকে বললো-
-শার্টগুলো পাচ্ছিনা তো..
পর্ণা গলা উঁচিয়ে উত্তর দিলো-
-ওখানেই তো সব ছিলো।
-আরে নীল শার্টটা...
-ওটা বোধহয় ছোটো আলমারিটায় আছে।কিন্তু আয়রন করা নেই।
আবির ছোটো আলমারি থেকে নীল শার্টটা বের করে একবার ভাবলো যে পর্ণাকে ডাকবে সে যদি আয়রনটা করে দেয়।কিন্তু পরমুহুর্তে ভাবলো যে,এবার তাকে ডাকলে সে রেগে যাবে।তাই সে নিজেই শার্টটা আয়রণ করে তারপর পরতে যাবে কী গেলো বুকের একটা বোতাম খসে।এবার?এবার কী হবে?এদিকে অফিসের জন্য দেরীও হয়ে যাচ্ছে।না না,আজ প্রমোশনের লিস্ট বেরোবে।নীল জামাটা ওকে সবসময় ভাগ্যের সাথে দেয়।ওটাই পরবে সে।বোতামটা সেলাই করবে বলে বেডরূমের মধ্যে এদিক ওদিক খানিক খোঁজাখুঁজি করে সে যখন সূঁচ সুতোর জায়গাটা পেলোনা
তখন তাকে আবার পর্ণাকে জিজ্ঞেস করতেই হলো-
-ছুঁচ সূতোর জায়গাটা কোথায় পর্ণা?
-কেন কী হবে?
-দেখোনা বোতামটা খসে গেলো..
-টেবিলের ড্রয়ারের একটু ভেতর দিক করে দেখো..
আবির ওখানটাতেও খুঁজেছিলো প্রথম বার পায়নি।এবার পর্ণা বলতে সে পেলো।সে মনে মনে ভাবলো পর্ণার যে এত কিছু কীকরে মনে থাকে কে জানে।সে সূঁচে সুতো পরাতে করতে পর্ণার রান্না কম্পলিট হয়ে যাওয়ার কারনে আবির কে সে ডাকতে এলো।আর এসে দেখে আবির তখনও সুতো আর সূঁচ নিয়ে নড়বড় নড়বড় করছে।তা দেখে পর্ণা আবিরের হাত থেকে সূঁচ সুতোটা নিয়ে হাসতে হাসতে বলল
-তোমার দ্বারা ওই অফিস ছাড়া আর কিচ্ছু হবেনা বুঝলে..
-কী করবো,এ কী ছেলেদের কাজ নাকি...তুমি পারবে আমি যেগুলো করি..?
-এমা,কাজ আবার মেয়েদের ছেলেদের কী,কাজ তো শেখার জিনিস।যে শিখবে সে-ই পারবে।ছেলেরা সেলাই মেশিনে কাজ করেনা নাকি মেয়েরা এরোপ্লেন চালায় না?
আবির পর্ণার সাথে কোনোদিন কথায় পেরে ওঠে না।কারন পর্ণা গৃহবধূ হলেও যুক্তি দিয়ে কথা বলে আর আবির এক জন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হলেও ওর কথার মধ্যে নিজেই ও ফেঁসে যায়।পর্ণা আবিরের বুকের ওপরেই শার্টের প্রথম ঘরের খসে যাওয়া বোতামটা লাগানোর জন্য শার্টের ওপর সূঁচ ফোঁটালে পর আবির-
-ধীরেসুস্থে করোনা।এত হুড়োতাড়া করছো কেন।যদি বুকে বিঁধে যায় ছুঁচটা..
-কটা বাজে খেয়াল আছে।অফিস যাবেনা বুঝি।
-সে দু দশ মিনিট দেরীতে গিয়ে বসের কথা শুনে নেবো না হয়।কিন্তু বুকে যদি একবার ছূঁচটা গেঁথে যায়,সে যন্ত্রনা আমি সহ্য করতে পারবো না।
-তোমাকে বসেরও কথা শুনতে হবেনা আর ছুঁচ ফোঁকার ব্যথাও পেতে হবেনা।এক মুহুর্ত চুপ করে দাঁড়াও খালি।
আবির পর্ণার কথা চুপ করলেও তার চোখ কিন্তু পর্ণার ওই হাতের ছুঁচটার দিকেই ছিলো।সেলাই শেষ হলে পর পর্ণা সুতো কাটতে মুখটা আবিরের বুকের ওপরে নিয়ে আসা মাত্র পর্ণার নি:শ্বাসের শব্দ আর চেহারার গন্ধ আবিরের মনটা মুহুর্তে মাতাল করে দিলো।আর সঙ্গে সঙ্গে তার মুখটাও পর্ণার সেই আসক্ত দেহসুবাস গ্রহন করতে পর্ণার গলার কাছে নেমে এলো।পর্ণা যেই না তা অনুভব করেছে সে সঙ্গে সঙ্গে-
-এই,কী হচ্ছে কী,মা এর পুজো সারা হয়ে গেছে।কখন কী চলে আসে।দূরে যাও।
-না যাবো না..
আবির পর্ণার স্পর্শের মধ্যে ক্রমশই জড়িয়ে আসছে দেখে পর্ণা আবিরকে বুকে ঢাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে বললো-
-যাও..সুতোটা কাটা হয়নি।নিজে কেটে নিগে যাও।
বলে আবিরের জন্য খাবার বাড়তে রান্নাঘরে ছুট্টে চলে গেলো।আবিরও নাছোরবান্দা।সে শার্টের বোতামের ওই সুতো খানা পর্ণাকে দিয়েই কাটাবে।ডাইনিংএ আবির ও তার মাও জলখাবারের জন্য বসলে পর পর্ণা সুযোগ বুঝে
টুক করে শ্বাশুরিমা'র চোখের আড়ালে আবিরের শার্টের বোতামটা দাঁতে করে কেটে দিলে পর আবির তার দিকে প্রশ্ন চিহ্ন চোখে জানতে চাইলো-
-কেন করলে এখন?
পর্ণা দু চোখে হাসির রেখা ফূটিয়ে আবিরকে বোঝালো-
-বেশ করেছি।
আবিরের মা খেতে খেতে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকলেও ওদের ওই খুনসুটি সব অনুভব করতে পারছিলো।আর পারা মাত্রই মনে মনে একবার ওনাদের সময়ের কথা ভেবেও হাসলেন।আবিরের বাবাও যে এমনটাই করতো ওনার সাথে।
পরদিন আবির ইচ্ছে করে শার্টের সামনের বোতামটা টেনে টুনে ছিঁড়ে ফেলে সোজা রান্নাঘরে সূঁচ সুতো নিয়ে হাজির।
তাকে ওই অবস্থায় দেখে পর্ণা বললো-
-আবার আজ ছিঁড়ে ফেলেছো বোতামটা?
-ছিঁড়ে ফেলেছি কোথায়।খসে গেছে তো।
-কই দাও দেখি..
বলে পর্ণা অভেনের ফ্লেমটা কমিয়ে রেখে আবিরের শার্টের বোতামটা লাগিয়ে দিয়ে আগের দিনের মতন সুতো কাটতে যাবে কী অমনি আবির রান্নাঘরের মধ্যেই তাকে জড়িয়ে ধরে তার গলার কাছে চুম্বন করতে যাবে কী পর্ণা লজ্জায় তাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বললো-
-আরে রান্না ঘরে এমন করোনা।মা চলে আসবে কখন।
-না,আজ তো আমি ছাড়বোনা।কাল তুমি আমার সাথে চালাকি করেছো।টু ডে ইজ মাই টার্ণ।
বলে চুমু খেতে যায় যায়।আর অমন সময় মায়ের ডাকটা এলো-
-বৌমা,আমার চশমাটা কোথায় দেখেছো..
সঙ্গে সঙ্গে আবির থতমত খেয়ে পর্ণাকে ছেড়ে দিলো।পর্ণা দেখে রান্নাঘরের দরজার সামনে শ্বাশুড়ি মা দাঁড়িয়ে আর ওনার চশমা ওনার চোখের ওপরেই।মানে উনি রান্নাঘরের ভেতরে ওদের কান্ড দেখে ফেলেই কী বলবে বুঝতে না পেরে ওটা জিজ্ঞেস করে ফেলেছে।
ডাইনিং এ খেতে বসবার সময় আবির লজ্জায় ওর মায়ের দিকে তাকাতে পারলোনা।আর পর্ণাও লজ্জায় যেন খানিক গুটিয়ে রইলো।ওদের ব্যাপার স্যাপার বুঝে ওদের মা ইচ্ছে করেই মুড়ির থালাটা হাতে নিয়ে একটা চেয়ার এগিয়ে নিয়ে গিয়ে টিভির সামনে বসলো।উনি উঠে যেতেই পর্ণা আবির কে চোখে চোখে বললো-
-তোমার জন্যই এমনটা হলো।
আবিরও চোখে চোখে উত্তর দিলো-
-আমি কীকরে জানবো মা এসে যাবে।
-কত করে বললাম।এমন করোনা রান্নাঘরে।
বেশ কিছুক্ষন চোখের ইশারায় ঝাল মিষ্টি খুনসুটির পালা মিটলে পর আবির পর্ণাকে ঠোঁটের ইশারায় বললো-
-একটা দাও..
পর্ণা চোখ বড় বড় করে-
-নাহ..মা আছে..
-দাওনা..দেখতে পাবে না..
-না বলছি..
-দাও..
-উফফ..এত জ্বালাও কেন বলোতো তুমি...
কথাটা বলে একবার টিভির দিকে পর্ণা তাকিয়ে দেখলো শ্বাশুড়ি মা টিভির দিকে তাকিয়ে আছে কিনা।তারপর টুক করে আবিরের গালে চুমুটা খেতে যাবে কী ঠিক সেই মোক্ষম সময় গেলো ইলেকট্রিক চলে।আর টিভির পর্দায় নায়ক নায়িকার স্ক্রিপ্টেড ভালোবাসার দৃশ্য সরে গিয়ে তাতে আবছায়া ফুটে উঠলো আর পর্ণার মিষ্টি দাম্পত্যের সুখের এক আবেগঘন মুহুর্ত।এবার লজ্জা পেলো আবিরের মাও।
আচমকা পর্ণার কানের ওপর ভেসে উঠলো তার বৌমার গলার আওয়াজ।
-মা,ও মা খাবেন আসুন না..
পর্ণা তার অতীতের কাটানো দিনগুলোয় এমন ভাবে হারিয়ে গিয়েছিলো তখনও তার দু চোখের পাতায় যেন চলচিত্রের মত ভেসে যাচ্ছে আজ থেকে বছর ত্রিশ আগে কাটানো তার আর আবিরের ভালোবাসার দিনগুলো।আবির তিনটে বছর হলো আর পর্ণার সাথে নেই।কিন্তু তার সাথে কাটানো এক একটা মুহুর্ত সে জীবন দিয়ে মনে রেখেছে।ভালোবাসার মানুষটাকে কী সত্যি কোনোদিন ভোলা যায়?আর সেই দিবা স্বপ্নের মধ্যে হারিয়ে থাকা অবস্থাতেই পর্ণা তার বৌমা বললো-
-দিব্যর জামায় বোতাম লাগানো হয়ে গেছে তোমার?
আসলে কোনো কিছুর ভাবনায় থাকলে।মন এক জিনিস দেখে আর মুখ এক কথা বলে ফেলে।যদিও আচমকা পর্ণার ওই পুরানো দিনগুলোয় হারিয়ে যাওয়ার কারনও হলো তার সন্তান দিব্য ও বৌমা চূর্ণির এক বিশেষ অনুরাগের মুহুর্ত এই ঘরের আসবার সময় তার চোখে পড়ে যাওয়া।পর্ণা তার ঘরে আসবার সময় দেখে ঠিক যেভাবে সে আবিরকে জামায় বোতাম লাগিয়ে দিয়েছিলো।ঠিক সেভাবেই চূর্ণি দিব্যর জামায় বোতাম লাগিয়ে দিচ্ছে।আর শ্বাশুরিমার মুখে শেষ কথাটা শোনা মাত্র চূর্ণিও লজ্জার মধ্যে পড়লো।তবে কী তাদের কান্ড শ্বাশুরিমার চোখে পড়েছে!
ভালোবাসা আসলে একটা পরম্পরা।যা দিনের পর দিন জীবনের এমন ছোটোছোটো মুহুর্তগুলো নিয়ে আজও প্রতিটা মানুষের জীবনে চিরস্থায়ী হয়ে আছে।যার সমাপ্তি নেই বলেই পৃথিবীটা আজও এত সুন্দর।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন