সম্পর্ক
সমাপ্তি পর্ব
লেখকঃ- Motiur Miazi
কেউ যদি পরিকল্পিতভাবে কারো জীবনের ক্ষতি করতে চায়, তাহলে সেই ক্ষতি থেকে কি বাঁচার কোন উপায় আছে ?
তুহিন আত্নবিশ্বাসী গলায় বললো, উপায় একটি আছে। উপায়টি কাজে লাগাতেই হবে, যদি কাজে লাগিয়ে সত্যিটা বের করতে পারি তাহলে দীর্ঘস্থায়ী হবে বিশ্বাস আর ভালবাসায় পরিপূর্ন একটি সম্পর্কের। আশিক বললো, চল বাসায় ফিরে যাই।
যা, আমি যাবো না!
যাবি না মানে! কেন যাবি না ?
তুহিন শঙ্কিত গলায় বললো, দাঁড়াবো কিভাবে ? তুই নিজেই বল, সঠিক প্রমান বের করতে না পারলে আনিকার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো কিভাবে ?
আরে বোকা টেনশন করে কি হবে ? এই মুহূর্তে বাসায় থাকাটা বেশি জরুরী, ফোনের এই ব্যাপারটি যদি বাসার সবাই জেনে যায় অবস্থাটা কি হবে চিন্তা করেছিস ?
আশিক ভুল বলেনি। তুহিনের বিয়ের অনুষ্ঠানে আসা কাছের আত্নীয় এখনো অনেকেই রয়ে গেছে। এই মুহূর্তে রিফাত নামের অপরিচিত মানুষের কথাগুলো জানলে পুরো ব্যাপারটি কেউ পজিটিভভাবে নিতে পারবে না! সবার মাথায় অদ্ভুত সব চিন্তা চলে আসবে, যেই চিন্তাগুলো খুব সহজেই তুহিন এবং আনিকার মাঝের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটি নষ্ট করে দিবে। তখন কি করবে তুহিন ? সম্পর্কটি টিকিয়ে রাখতে পারবে তো ?
দু'জনে বাসায় ফিরে যাওয়ার জন্য দেবপুর স্টেশন থেকে সিএনজিতে উঠলো। দেবপুর হলো তুহিনদের বাড়ি থেকে সবচেয়ে কাছের স্টেশন, স্টেশনের সাথে একটি দিঘী রয়েছে। দিঘীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে দেবপুর দিঘীর পাড়ের বাজার। বাজার থেকে সিএনজি করে বাসায় যেতে এক ঘন্টা লাগে। তবে সিএনজি পাঁচ জন যাত্রী ছাড়া ছাড়ে না! তারাতারি বাসায় ফিরে যাওয়ার জন্য তুহিন সিএনজিটি রিজার্ভ নিয়ে নিলো।
সিএনজি দ্রুত গতিতে চলছে। ভেতরে দু'জনেই চুপচাপ বসে আছে। ড্রাইভাররা গাড়ি চালাতে সময় যাত্রীর সাথে কথা বলতে পছন্দ করে। এই ড্রাইভার ব্যতিক্রমী, সে নিজে ও কোন শব্দ না করে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। পাঁচ মিনিট পরেই গাড়ি তুহিনের বাসায় পৌঁছে যাবে। তুহিন হঠাৎ নিরবতা ভেঙ্গে বললো, মামা গাড়ি ঘুরান।
গাড়ি ঘুরাবো মানে! বাসায় যাবি না ? আশিকের কণ্ঠে বিরক্তির ছাপ।
তুহিন উত্তেজিত গলায় বললো, না! ড্রাইভার মামা এক্ষুনি গাড়ি ঘুরান, দেবপুর বাজারে ফিরে যেতে হবে।
গাড়ি ঘুরানো হলো। হঠাৎ করে গাড়ি ঘুরিয়েছেন কেন ? ড্রাইভার এ'জাতীয় কোন প্রশ্ন না করে আগের মতো চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে।
গাড়ি দেবপুর বাজারে এসে থামলো। আশিক তুহিনের কর্মকান্ড কিছুই বুঝতে না পেরে কঠিন গলায় বললো, এখানে ফিরে আসার কোন মানেই হয় না! শুনি তো, কি করবি এখন ?
সিমের কাষ্টমার সার্ভিস পয়েন্টে যাবো।
আবারো কেন যাবি ?
তুহিন আত্নবিশ্বাসী গলায় বললো, দেখবো আজকে দিনে এই সার্ভিস পয়েন্টে কতোটা সিম ডিএক্টিভ করা হয়েছে।
আশিক বললো, পাগল হয়ে গেছিস ? রিফাত নামের ছেলেটি এখানে এসে সিম ডিএক্টিভ করাবে কেন ?
তুহিন শীতল গলায় বললো, আমার বাসা থেকে এই সার্ভিস পয়েন্টটি সবচেয়ে কাছে। যদি আমার পরিচিত কেউ হয়ে থাকে তাহলে এখান থেকেই ডিএক্টিভ কারাবে। অনিকার পরিচিত কেউ হলে কিছুই করার নেই! তবে চেষ্টা করে তো দেখতে পারি ?
ঠিক বলেছিস, আনিকার পরিচিত কেউ হলে ডিএক্টিভ করাতে এখানে আসার প্রশ্নই উঠে না! চল দেখি আজকে দিনে যে সিমগুলো ডিএক্টিভ করেছে, ডিএক্টিভ করা নম্বরের লিষ্টের সাথে ফোন দেওয়া নম্বরটি মিলে কিনা.....
স্যার আপনারা আবার এসেছেন কেন ? বলেন কি হেল্প করতে পারি।
সার্ভিস পয়ন্টের কর্মকর্তার কথা শুনার পর পরই আশিক বললো, আজকে সকাল থেকে এই পর্যন্ত যতোটা সিম ডিএক্টিভ করা হয়েছে, সেই লিষ্টটি প্রয়োজন।
সরি স্যার, এই লিষ্ট বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সাধারণ কাষ্টমারকে দেখানোর নিয়ম নেই।
তুহিন বিনয়ীর স্বরে বললো, ব্যক্তিগত প্রয়োজনের হিসবেটা যখন একটি সামাজিকতার বন্ধনের ভবিষ্যত নির্ভর করে, তখন কি সেই প্রয়োজনটাকে আপনারা বিশেষ প্রয়োজন বলবেন না ?
সকাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট তিনটি সিম ডিএক্টিভ করানো হয়েছে। সার্ভিস পয়েন্টের কর্মকর্তা ল্যাপটপ থেকে তিনটি নম্বর প্রিন্ট করে তুহিনের হাতে দিতেই তুহিনের চোখ আনন্দে ঝলমল করে উঠলো। রিফাত পরিচয় দেওয়া অপরিচিত নম্বরটি ডিএক্টিভ করা সিমের লিষ্টের প্রথমেই রয়েছে।
তুহিনের শ্বশুরবাড়ি অর্থাৎ আনিকাদের বাড়ি দেবপুর বাজার থেকে একশো বিশ কি.মি. দূরে। আনিকার পরিচিত কেউ এতো দূর থেকে দেবপুর বাজারের সার্ভিস পয়েন্টে এসে সিম ডিএক্টিভ করাবে না। তুহিনে ভাবলো, আমার পরিচিত যেই মানুষটি এই কাজটি করেছে, কেন করেছে ? সে তো আমার নামে মিথ্যা অভিযোগ দিলে পারতো, আনিকার নামে কেন দিলো ?
আশিক মোটা গলায় বললো, আপনাদের দরজায় লাগানো সিসি ক্যামেরার আজকের দিনে রেকর্ড করা পুরো ভিডিও ফুটেজটি দেখান। সিমটি ডিএক্টিভ করানোর জন্য যে ছেলেটি এসেছিল তাকে দেখতে চাই, হয়তোবা দেখলেই চিনতে পারবো।
সার্ভিস কর্মকর্তা চেয়ার থেকে উঠে সিসি ক্যামেরা মনিটরিং ল্যাপটপের সামনে গিয়ে বসলো। তুহিন ও আশিক তার পিছনে দুটি চেয়ার টেনে পাশে বসলো। সকাল থেকে সিসি ক্যামেরায় রেকর্ড করা ভিডিও ফুটেজটি প্রথম থেকে চালু করা হলো। ভিডিও টেনে টেনে দেখতে হলো না, ভিডিও শুরুর দশ মিনিটের মাথায় তুহিন একই সাথে বিস্মিত এবং হতভম্ব হয়ে গেল। ভিডিওতে তুহিনের পরিচিত খুব কাছের একজন মানুষকে সার্ভিস পয়েন্টে ডুকতে দেখা গেলো। সে আর কেউ নয়, তুহিনের বেষ্ট ফ্রেন্ড নিশি!
আশিক বরফ শীতল গলায় বললো, ভেবেছিলাম পরিচিত কোন ছেলে বন্ধু হবে। কিন্তুু নিশি! নিশি তর বেষ্টফ্রেন্ড হয়ে কেন এই কাজটি করতে গেলো। নিশি কি চায় ?
জা-নি-না। বুঝতে পারছি না, নিশি কেন পরিকল্পিতভাবে আমার ক্ষতি চাচ্ছে ? কথাগুলো বলতে গিয়ে তুহিনের গলার স্বর আটকে গেলো। তুহিনের এমন মুহূর্তটি দেখে সার্ভিস কর্মকর্তা নিয়ে ও মর্মাহত হলেন।
চল, এক্ষুনি নিশির বাসায় যাবো ? বলেই আশিক উঠে দাঁড়ালো। তুহিন বললো, আমরা দু'জন নয় সাথে আনিকাকে ও নেবো। নয়তো আনিককে সন্দেহ করার কারণে অপরাধী হয়ে থাকতে হবে। পৃথিবীতে কোন স্বামীই তার স্ত্রীর কাছে বিনা অপরাধে অপরাধী হয়ে থাকতে চায় না, উল্টো নিজের ভুলগুলো ডেকে রাখতে চায়।
আশিককে নিয়ে তুহিন বাসায় ফিরে এসে সামান্য দেরি করলো না। আনিকাকে সাথে নিয়েই নিশির বাসায় রওনা দিলো। আমাকে সাথে নিয়ে কোথায় চাচ্ছেন ? কি হলো বলেন, আমি সাথে গিয়ে কি করবো ? নিশির বাসায় পৌঁছার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আনিকা তুহিনকে এ'জাতিয় ছোট খাট অনেক প্রশ্ন করলো। তুহিন কোন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নিশির বাসায় এসে পৌঁছলো।
নিশিদের বাসার ড্রয়িং রুমটা বিশাল। নিশির বার্থ-ডে দিন ছাড়া ও এখানে তুহিন আরো কয়েকবার এসেছে। নিশির মা তুহিনকে দেখে বললো, নতুন বউ নিয়ে এসেছ দেখে খুশি হলাম। তোমরা বসো আমি কফি নিয়ে আসছি।
তুহিন শব্দ করে বললো, আন্টি কফি আনতে হবে না! নিশিকে ডাকুন। ইনপর্টেন্ট কিছু কথা আছে, আপনি ও বসুন।
নিশিকে ডাকা হলো, নিশি তুহিনের সামনা-সামনি সোফায় বসতেই নিশির মা বললো, বাবা কোন সমস্যা ?
তুহিন কিছু বলার আগেই নিশি বললো, নতুন বউ সাথে আছে। মা তুমিই বলো, সমস্যা থাকবে কেন ? যাও তো, তুমি সবার জন্য নাস্তা নিয়ে আসো।
তুহিন হাতে ফোনটি সামনে এগিয়ে নিয়ে ফোনের কল লিষ্টের নম্বরটি নিশিকে দেখিয়ে বললো, এই নাম্বারে ফোন দিয়ে আনিকার নামে এসব বাজে কথা বলেছ কেন ?
নিশি চোখ বড় বড় করে বললো, আমি ফোন দিয়ে বাজে কথা কেন বলতে যাবো ?
পাশে বসে থাকা আশিক উঠে গিয়ে বললো, ফোনটি তুমি দাওনি, তবে পুরো পরিকল্পনাটি তোমার ছিল। এই নম্বরের সিমটি আজকে সকালেই সার্ভিস পয়েন্ট থেকে ডিএক্টিভ করে এসেছ, তার ভিডিও ফুটেজ দেখাবো ? দেখবে ভিডিও ?
আন্টি ভয়ার্ত গলায় বললো, নিশি কি শুনছি এসব ? তুই তর বেষ্টফ্রেন্ডের বিয়ের পরবর্তী জীবনের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা ভাঙ্গতে চাচ্ছিস কেন ?
নিশি চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছে। মুহূর্তেই চোখ লাল করে বললো, আমি আর তুহিন দু'জনের বন্ধুত্ব তৈরি হওয়ার পর থেকেই তুহিনকে আমি ভালবেসে ফেলি। কিন্তুু তুহিন.....
তুহিন বললো, কিন্তুু কি ? আমার অপরাধটা কি ছিল ?
নিশি বললো, তুই কখনোই আমাকে বন্ধুর চেয়ে বেশি ভালবাসিস নাই! এমনকি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ও কথা বলিস নাই। শুধু আমি কেন, কোন মেয়েই তার ভালবাসার পুরুষটির অন্য কারো সাথে বিয়ে হউক এটা চাইবে না! আমি ও চাইনি ?
তুহিন গলা উঁচু করে বললো, নিশি তর ধারণা ভুল। সত্যিকারের ভালবাসলে ভালবাসার মানুষটির কখনো কষ্ট হউক এটা চাইতে না! জানিস রাতে ফোনটি পাওয়ার পর বাকি মুহূর্তটা আমার কতোটা কষ্টে গেছে।
নিশি মাথা নিচু করে সোফায় বসে আছে। কেউ কোন কথা বলছে না। তুহিন হাই তুলতে তুলতে বললো, বন্ধুত্ব এবং ভালবাসার সম্পর্কের অনুভুতিগুলো সম্পূর্ন আলাদা। তুই নিজে ও বুঝতি তর সাথে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্কের বাইরে আর কোন অনুভূতি ছিল না। তাহলে কেন আমার সাথে এমনটা করলি ? প্রকৃত ভালবাসলে অপর মানুষটির কষ্ট হউক এটা কখনোই চাইতি না!
আশিক বললো, নিশি এখন চুপ করে আছো কেন ? চল তুহিন এখানে বসে থাকার কোন মানেই হয় না!
তুহিন উঠে দাঁড়াতেই আনিকা বললো, যেই মানুষটি আমাকে কষ্ট না দিয়ে ভালবাসার জন্য সঠিক প্রমাণ খুঁজতে গিয়ে এতো কিছু করতে পারে, আমার বিশ্বাস সেই মানুষটি নিশিকে ও ক্ষমা করে দিতে পারবে। মেয়েদের জীবনটাই এমন - ভালবাসার স্রোত তাদের জীবনটাকে এমনভাবে পাল্টে ফেলে নিজেরাই বুঝতে পারে না- কোনটা ভুল, কোনটি সঠিক ?
তুহিন দ্বিতীয় বারের মতো আনিকার চোখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো। এই দৃষ্টি আনিকার কথাগুলো মেনে নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটি ভালবেসে এগিয়ে নেওয়ার দৃষ্টি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন