Breaking

রবিবার, অক্টোবর ২৯

ভালোবাসা

 




অর্ক আর শ্রেয়া খানিক্ষন নি:শব্দে পাশাপাশি ভিক্টোরিয়ার ওই বড় ঝিলটার নিরিবিলিতে বসে ছিলো।কারোর মুখে টু শব্দটি নেই।একদিন এখানেই ওদের সম্পর্কের জার্নি শুরু হয়েছিলো।আর আজ হয়তো এই ঝিলকেই সাক্ষী রেখে তারা একে ওপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।যদিও বিচ্ছেদের এই ডিশিসনটা অর্কর না।শ্রেয়ারই একান্ত।কী কারন সেটা অর্ককেও সে সঠিক ভাবে জানায়নি।



অবশেষে নি:স্তব্ধতা কাটিয়ে ভীষন করুন সুরে অর্ক বলে উঠলো-
-কেন এভাবে সম্পর্কটা ভাঙতে চাইছিস শ্রেয়া?
শ্রেয়া এবার মুখ খুললো-
-দেখ অর্ক।আমাদের মধ্যে আর আগের মত ব্যাপারটা নেই।
সেই কমিউনিকেশন সেই যে চার্মটা ছিলো আমাদের সম্পর্কে সেইটা কোথাও যেন হারিয়ে গেছে।এখন আমরা
সম্পর্ক রাখতে হয় তাই যেন রাখছি।কটা দায়িত্ব পালন করছি শুধু মাত্র।এভাবে আমরা একদিন ভালো থাকতে পারব না।


-কেন এমন করে ভাবছিস তুই সবকিছুটা।সময় দিতে পারছিনা তো আমরা একে ওপরকে তো আমরা সময় বের করবো।আবার আগের মত দেখা করবো।কথা বলব।সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস।একটু সময় দে।
-হবে না।কিছু জিনিস ঠিক হয়না।আর জোর করে কদিন তুই সবকিছুটা ঠিক করবি বল।যেটা মন থেকে আমাদের আর হচ্ছেনা সেটা কোনোদিনের জন্য আর মন থেকে আসবে না।


অর্ক এবার আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলোনা।সে শ্রেয়ার পায়ের নীচে বসে শ্রেয়ার হাতদুটো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাকুতির সুরে বললো-
-এভাবে ছেড়ে যাসনা মাঝখানে।আমি শেষ হয়ে যাবো রে। একবার চেষ্টা কর তুই।আমিও করি।দুজনে মিলে চেষ্টাটা করলে সব আগের মত হয়ে যাবে।
-বললাম না হবে না।আমাদের মাঝে সেই টানটা যেটা আমরা প্রতিদিন প্রতিটা মুহুর্ত অনুভব করতাম।একে অপর কে না দেখে,কোনো কথা শেয়ার না করে থাকতে পারতাম না সেটাই তো নষ্ট হয়ে গেছে।অন্তত আমি তো সেই টানটা আর অনুভব করতে পারছিনা তোর সাথে।এর চেয়ে ভালো কী সময় থাকতে থাকতে দূরে সরে যাই।আমাদের ফ্যামিলি কে জানিয়ে দিই সবটা।



-প্লিজ।এমন করিস না।একবার শোন আমার কথা।তুই কি অন্য কাউকে ভালোবেসে ফেলেছিস বল?
-দেখলি তো।তুইও কেমন সন্দেহ করতে শুরু করেছিস আমায়।তোর মনে এই ভয়টা জন্মেছে যে আমি তোর থেকে দূরে চলে যাচ্ছি মানেই আমি অন্যকোথাও এনগেজড হয়ে গেছি।
-তাহলে কী,আমি কী করবো,কিছু বুঝতে পারছি না।আমি আমার নিজের কন্ট্রোলে নেই।তুই না থাকলে আমি এভাবে এলোমেলো হয়ে যাই কেন বুঝিসনা।




-দেখ।একটা কথা জানবি,এই পৃথিবীতে,এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে যদি কেউ তোকে খুব ভালো করে বোঝে তবে সেটা আমি। আর বুঝি বলেই বলছি,দূরে যা আমার থেকে।নতুন করে সবটা শুরু কর।নতুন মানুষকে আসতে দে।দেখবি আবার তোর জীবনটা ভরে উঠবে।
অর্কর দুচোখ আর চুপ করে থাকতে পারলোনা।সে অঝোরে কেঁদে উঠলো।কান্না মাখানো সুরে সে পাগলের মত শ্রেয়ার হাতদুটো শক্ত করে ধরেই তার কোলে মাথাটা রেখে বলতে লাগলো-
-আমার কাউকে লাগবে না তুই ছাড়া।তোর কাছে আমি সব থেকে ভালো থাকি।তুই আমাকে সবার থেকে ভালো বুঝিস। মরে যাবো আমি।



শ্রেয়ার এবার অর্কর মাথার ওপর হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো-
-এমন পাগলামো করে না অর্ক।নিজেকে সামলা।আমি তো দেখনা নিজেকে কেমন বুঝিয়ে নিয়েছি যে তোর থেকে আমাকে দূরে যেতেই হবে।এবার তুইও বুঝিয়ে নে।একদিনে পারবিনা।কিন্তু একদিন নিশ্চই পারবি।কই দেখি তোর ফোন টা দে।
বলে অর্কর পকেট থেকে শ্রেয়া তার ফোনটা বের করে নিয়ে লক স্ক্রিনে তার নিজের নামেই রাখা পাসওয়ার্ড প্রেস করে গ্যালারি থেকে তাদের দুজনের ছবি,ফোন নম্বর,মেসেজ হোয়াটসঅ্যাপ সব ডিলিট করে দিতে লাগলো।অর্ক তা দেখে বাধা দেওয়ার আপ্রান চেষ্টা করলে পর শ্রেয়া তাকে তা করতে দিলোনা।অর্ক কোনোদিন শ্রেয়ার ওপর জোরটা করতে পারেনা।সব কাজ মিটে গেলে শ্রেয়া তার মোবাইলের পাসওয়ার্ডটাও চেঞ্জ করে দিয়ে অর্কর হাতে ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে বললো-
-নতুন পাসওয়ার্ড দিলাম।এখন থেকে এটার অভ্যেস করে নিস।




কথাটা বলে সে উঠে পড়লো।অর্কর দু চোখ বেয়ে তখনও অঝোরে কান্না বয়েই চলেছে।তার জীবন যে তার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে আজীবনের জন্য।আর অর্ক ভালোকরেই জানে যে শ্রেয়া একবার যেটা ঠিক করে নেয় সে সেটা করবেই।ও এতটাই জেদী।তাকে ভালোবেসে পরিবারের বিরুদ্ধে যাওয়ার জেদ ধরে রেখেছিলো বলেই তাদের পরিবার থেকে অর্ককে মেনে নিয়েছিলো আর আজও..।
অর্কর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া মাত্র শেয়া এতক্ষন যে তার দুচোখের জল চেপে রেখেছিলো কোনো মতে সেটা সে আর চেপে রাখতে পারলো না।অঝোরে কাঁদতে শুরু করে দিলো।অর্ক তা জানতে পারলোনা।অর্ক তো এও জানলোনা যে শ্রেয়া তাকে কেন দূরে সরিয়ে দিলো নিজের জীবন থেকে।সেও তো তাকে নিজের চেয়ে বেশি ভালোবাসতো।




কিন্তু শ্রেয়ার বুকের ভেতরটা সেই মুহুর্তে পুড়ে খাঁ খাঁ হয়ে যাচ্ছিলো।তাই সে একবার নিজের চোখের জলটা মুছে মুখ ফিরিয়ে অর্ককে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে ফের ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো।আর পিছু ফিরলোনা।অর্কর বুক থেকে শ্রেয়ার স্পর্শ যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো তখন অর্ক অনুভব করলো সে আর এই পৃথিবীতে নেই যেন।




ওদের বিচ্ছেদের মাস তিনেক পরের ঘটনা এটা।শ্রেয়ার তখন ক্যানসারের লাস্ট স্টেজ।তার ইচ্ছেতেই অর্কর মা অর্কর এত তাড়াতাড়ি বিবাহ স্থির করেছিলো।যা অর্কও জানতোনা।কারন অর্কর সাথে এই শেষ তিনমাসে একবার ও শ্রেয়ার কথা হয়নি।অর্ক হাজার বার যোগাযোগের চেষ্টা করেছে তবু শ্রেয়া তার সাথে যোগাযোগ করেনি।সে শুধু গোপনে কেঁদে গেছে নি:স্ব হয়ে।কারন সে জানতো যে অর্ক যদি তার ক্যানসারের কথা শোনে তাহলে সে শেষ হয়ে যাবে।কারন অর্ক তাকে এতটাই ভালোবাসে।এতটাই।যতখানি ভালোবাসলে কাছের মানুষটার জন্য নি:শেষ হয়ে যাওয়া যায়।




অর্কর আজ বিয়ে।অর্ক শ্রেয়াকে ভুলতে পারেনি ঠিকই।কিন্তু বারবার শ্রেয়ার থেকে অবহেলা পেয়ে পেয়ে শ্রেয়ার ওপর থেকে সেই মায়াটা কোথাও গিয়ে তার হারিয়ে গেছে। মায়ের পছন্দ করা পাত্রীকেই সে বিয়ে করতে সম্মতি দিয়ে ফেলেছে।আসলে সেই পাত্রী তার মায়ের দেখা না।শ্রেয়ারই দেখা।সেই মেয়েটাকে শ্রেয়াই পছন্দ করেছে অর্কর জন্যে।

শেষবার যখন শ্রেয়ার সাথে অর্কর হবু স্ত্রীর দেখে হয়েছিলো শ্রেয়া মেয়েটার দু হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো-
-আমার মানুষটাকে আজীবনের জন্য তোমায় দিয়ে গেলাম। ওকে আগলে রেখো।আমি তো আর পারলাম না।তোমাকে পারতে হবে কিন্তু।পারলে আমাকে ভুলিয়ে দিও তুমি ওর জীবন থেকে।




মেয়েটা শ্রেয়াকে কথা দিয়েছিলো যে-
-ওর সব দায়িত্ব এখন আমার।আমি ওকে আপনার মতই ভালোবাসা দেওয়ার চেষ্টা করবো।
বিবাহ মন্ডপে তখন অর্ক আর স্নিগ্ধার মালাবদলের দৃশ্য অনুষ্ঠিত হচ্ছে।অর্কর মাকে অনেক করে বলতে তিনি শ্রেয়া কে ভিডিও কলে অর্কর বিবাহের দৃশ্য দেখাতে বাধ্য হলেন। শ্রেয়ার অসুখে শুকিয়ে যাওয়া মুখটার দিকে যেন তাকানো যায়না।ভিডিও কলে শ্রেয়াকে নেওয়ার পর তিনি সন্তানের বিবাহের মুহুর্তেও চোখের জল ফেলছেন।তাই দেখে শ্রেয়া বললো-
-কাকিমা,তুমি কেন এমন করে কাঁদছো বলোতো।তোমার ছেলের বিয়ে আজ।চোখের জল ফেললে অমঙ্গল ঘটবে। এই দেখো,আমি কেমন হাসছি।তুমিও হাসো।আমার দিব্যি কিন্তু।





চোখের জল মুছে অর্কর মা মুখে মিথ্যে একটা হাসি ফোটালো।তারপর শ্রেয়ার দিকে মায়াভরা চোখে তাকিয়ে বললো-
-অর্কর পাশে তো তোকে দেখতে চেয়েছিলাম রে মা।সব কেমন করে যেন ওলোটপালট হয়ে গেলো।
-আর কাঁদবে না বলে দিচ্ছি।এবার আমিও কিন্তু কেঁদে ফেলবো।
আর সত্যি শ্রেয়াও কেঁদেই ফেললো।চোখের জল ধরে রাখতে পারলোনা।সে ফের চোখ মুছতে মুছতে আটকে আটকে বললো-
-ওকে কিন্তু কোনোদিন বলবেনা তুমি যে কেন আমি ওর থেকে দূরে সরে এসেছি।ও সত্যিটা জানলে শেষ হয়ে যাবে।বলবেনা কিন্তু কথা দাও।বরং পারলে বলো,শ্রেয়া তোকে ঠকিয়েছে।




শ্রেয়ার শেষ কথাটা শুনে ফের অর্কর মা কেঁদে ফেললো-
-আমি পারবোনা এমন মিথ্যেটা বলতে।পারবোনা আমি।
অর্ক আর স্নিগ্ধার মালাবদল সম্পন্ন হলো।এবার সিঁদূর দানের পালা।সিঁদূর দানের দৃশ্য শুরু হলে পর শ্রেয়া একবার চোখ বন্ধ করে স্নিগ্ধার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে সুখে আবিষ্ট হলো।তারপর সেই পরম সুখ বুকে নিয়ে সে এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে আজীবনের জন্য হারিয়ে গেলো অন্য পৃথিবীর মায়ায়।




ভালোবাসার মানুষগুলো হয়তো কোনো কারনে একদিন না একদিন দূরে সরে যায়।কিন্তু ভালোবাসাটা কোনোদিনও হয়তো মরে না।ভালোবাসা অন্তরের কোনো এক কোনে ঠিক নিজের জায়গা করে নিয়ে থেকে যায় নিজের মতন।

একটা গান এই মুহুর্তে খুব মনে ভাসছে-
-"বাতাসে প্রবাদ আর আকাশে আদীম ধ্রুবতারা
না না কিচ্ছু চাইনি আমি আজীবন ভালোবাসা ছাড়া।"

সত্যি ই তো।সময়ের সাথে সাথে কত কী না আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যায়।কিন্তু ভালোবাসা নামের শব্দটা কী কোনোদিন হারিয়ে যেতে পারে?বুকে হাত রেখে বলুনতো?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন