শুক্রবার, ডিসেম্বর ১

মন







-সুভদ্রা..এই সুভদ্রা..হলো তোমার?

-এই যে..শাড়িটা পরছি।আর একটু।

-কতক্ষন ধরে শাড়ি পরছো বলোতো।ওদিকে দশটা পঁচিশটা আর পাবোনা এত দেরী করলে কিন্তু।

-আসছি আসছি।তুমি ততক্ষনে রান্নাঘরটা একবার দেখে এসোনা গ্যাসট্যাসগুলো ঠিকমত বন্ধ আছে কিনা..।

-তোমার বলার আগে আমি দেখে এসেছি।তুমি তাড়াতাড়ি নাও একটু।

সুভদ্রা মিনিট পাঁচেক পর পরিপাটি করে শাড়ি পরে চুলটা সুন্দর করে আঁচড়ে ভেতরের ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলে পর সঙ্গে সঙ্গে অনুপম দরজার তালা চাবিটা হাতে নিয়ে-

-চলে এসো চলে এসো।এখন আবার একটা টোটো পেলে হয়।

সুভদ্রা অনুপমের প্রিয় নীল শাড়ি পরেছে।তাই সে ভেবেছিলো অনুপম অন্তত তাকে একবার একটু প্রশংসা
করবে।কিন্তু অনুপম তো ওর দিকে তাকালোই না ভালো করে।

কপাল ভালো তারা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার ওপর একটা টোটো পেয়ে গেলো স্টেশনে যাওয়ার।দুজনে টোটোয় উঠে বসলো।টোটো ছাড়তে অনুপম সুভদ্রাকে বললো-

-ভালো করে কলেজের সব কাগজপত্র নিয়েছো তো সাথে করে গুছিয়ে?

সুভদ্রা ঘাড় নেড়ে মুখে একটা অস্ফুট শব্দ করে জানান দিলো অনুপমকে-

-নিয়েছি।

-এবারটা কিন্তু তোমাকে মাস্টার্সটা কম্লিট করতে হবে।

-আমার আর ভাল্লাগেনা পড়াশোনা করতে।কেন যে আবার আমায় ভর্তি করাচ্ছো তুমি।তাও আবার বাপের বাড়ির ওখানের কলেজে।অতদূরে কলেজ ভাল্লাগে বলো।

-বিয়ের আগে তুমি আমার কাছে কী চেয়েছিলে যে তুমি হায়ার স্টাডিজের জন্য পড়বে।আর এই দুবছরে হঠাৎ কেন মত বদল হয়ে গেলো তোমার?

-তখন খুব জেদ ছিলো মাস্টার্স কম্পলিট করবো।তারপর নেট ক্র্যাক করে কলেজে পড়াবো।

-তাহলে,আমি কী তোমায় বারণ করেছি যে পড়াশোনা না করতে?

-সময়ের সাথে তো মানুষের সবকিছু বদলায় বলো..

-তা বলে স্বপ্ন দেখাও বদলে যাবে?আমি এটা মানতে পারব না।আমি চাই তুমি তোমার স্বপ্ন নষ্ট হতে দিওনা।

-তাহলে সংসারটার কী হবে?মায়েরও তো আজকাল শরীর ভালো যাচ্ছেনা।

-আমি আছি কী জন্য।

-তোমার তো অফিস থাকে।সারাদিন থাকোনা।সংসারে কী হয় না হয় তুমি এসব জানো।তুমি জানো মা কোন ওষুধটা খায়?

-পড়াশোনার সাথে সাথেও এগুলোর খেয়াল রাখা যায়।আর বললাম না আমি আছি।নিজের অফিসের বাইরে নয়
বন্ধু বান্ধবদের সাথে সময় কাটানোটা কমিয়ে দিয়ে তোমায় সাহায্য করবো।

এর পর আর সুভদ্রার কী বলার থাকে।সুভদ্রা মাঝে মাঝে ভাবে প্রতিটা সংসারে স্বামীদের কোনো না কোনো বদ গুন থাকেই।এই তার স্বামীটা যে এত ভালো মানুষ হয়েছে কেন কে জানে।আবার মাঝে মাঝে এটাও ভাবে যে ভাগ্য করে এমন একজন স্বামী পেয়েছি যাকে করে গর্ব করা যায়।কিন্তু সবই ভগবান দিয়েছে।শুধু অনুপমের মধ্যে যদি আর একটু রোমান্টিক ব্যাপারটা বেশি করে দিত।অনুপম কেমন যেন আনরোমান্টিক।দায়িত্ববোধ পালনের দিকে তার মত ছেলে দুটো হবেনা।কিন্তু কেমন যেন।দুটো হাসি মুখে কথা বলেনা। তার সাথে সময়ে সময়ে প্রেমালাপ করেনা।

দশটা পঁচিশের লোকালটা যাক তারা পেয়ে গেলো।সুভদ্রা মনে মনে ভাবলো,যদি ট্রেনটা মিস হতো অনুপম তাকে নি:ঘাত দোষারোপ করতো যে তোমার শাড়ি পরার দেরীর জন্য ট্রেনটা হাতছাড়া হয়ে গেছে।কিন্তু,কী করবে,সুভদ্রাতো অনুপমের জন্যই একটু সাজুগুজু করছিলো।আর সেই কি না একবারের জন্য তাকে দেখে প্রশংসার টু শব্দ টুকু করল না।হায়!

ট্রেনে যেতে যেতে অনুপম সুভদ্রাকে জিজ্ঞেস করলো-

-কিছু খাবে?নেবো?

-ডালমুট খাবো।নাওনা।কতদিন খাইনি।

-ডালমুট!তোমার সেই যত আজে বাজে খাবার।ভালো কিছু খেতে পারোনা?

-আমি তো যাই বলি যাই করি সেটাই তোমার পছন্দ হয় না। আমি কী করবো তাতে।তার থেকে ভালো তুমি তোমার পছন্দ মত কিছু একটা নিয়ে নাও।আমি খেয়ে নেবো।

অনুপম বুঝলো সুভদ্রার রাগ হলো।সুভদ্রা তাই জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে রইলো।অনুপম আর তাকে কিছু বললোনা।সেও জানে সুভদ্রা বেশি রেগে গেলে কথা বলাই বন্ধ করে দেবে।তার চেয়ে থাক বাবা।

বেশ কয়েকটা স্টেশনের পর একজন বাচ্চাদের খেলনা বিক্রেতা ওই কামরায় এসে তার খেলনা বিক্রি করতে লাগলো।অনুপম খেয়াল করলো সেই একটা লম্বা ডান্ডির ওপর পাখা দেওয়া একটা জিনিসটার দিকে সুভদ্রা তাকিয়ে হাসছে আর কী যেন ভাবছে।ওই জিনিসটার কথা সুভদ্রা আগেও বেশ কয়েকবার অনুপমকে বলেছিলো।আসলে, সুভদ্রার অন্তরটা এখনও ছেলেমানুষ রয়ে গেছে।তার মধ্যে সেই গিন্নি গিন্নি ভাবটাই আসেনি।খেলনা বিক্রেতা ওখান থেকে চলে গেলে পর অনুপম একবার সুভদ্রাকে বললো-

-আমি একটু আসছি।তুমি বসো।

অনুপম চলে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষন পরেও সে আসছেনা দেখে সুভদ্রা একবার সীট ছেড়ে উঠে দেখতে লাগলো যে সে কোথায় গেলো।কিন্তু অনুপমের টিকির দেখাটা পর্যন্ত পেলোনা।এবার একটু চিন্তা হচ্ছে তার।এদিকে নামার সময় ও হয়ে এসেছে যে।একটু অস্থির ভাবে সে যখন নিজের দাঁত দিয়ে নোখ কাটতে শুরু করলো তখন হঠাৎ অনুপম এসে হাজির।আর তাকে দাঁতে নোখ খাচ্ছে দেখেই হেসে-

-আবার বাচ্চাদের মত নোখ খাচ্ছো?

-কোথায় গিয়েছিলে তুমি?

-কেন,চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলে নাকি?

-না।অনেক ক্ষন গেছো তাই..

-কেন,একা পরের স্টেশনে নামতে পারতে না?

-নামতে কেন পারবো না।আমি কত যাতায়াত করেছি এই ট্রেনে।কিন্তু তোমাকে না জানিয়ে নেমে যাবো।

-বুঝেছি।চলো বসো।

-আর কেন বসবো।চলোনা একটু দরজার সামনেটায় গিয়ে দাঁড়াই।আমার না বেশ লাগে ওই খানটায় দাঁড়াতে।কিন্তু মাথা ঘোরে।

অনুপম হেসে বললো-

-চলো।আমি পাশে থাকবো।

সুভদ্রা একবারও ভাবেনি যে অনুপম তার একবার বলাতেই তার আবদার মেটাবে।তাই অবাক চোখে অনুপমের দিকে একবার তাকালো।অনুপম তা দেখে সুভদ্রাকে বললো-

-কী হলো,চলো,কী দেখছো অমন করে?

সুভদ্রা অনুপমের পিছু পিছু দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আহা।বেশ লাগছে তার চলন্ত ট্রেন থেকে বাইরেটা দেখতে। আবার ভয়ও করছে যদিও।হঠাৎ ট্রেনটা একবার ঝাঁকুনি দিলে পর সুভদ্রা ভয়ে অনুপমের হাতটা জাপটে ধরলো। অনুপম আড়চোখে তার স্ত্রীর ভয়ার্ত মুখখানা দেখে যেন বিগলিত হয়ে পড়লো।কত নির্মল আর স্নিগ্ধ মেয়ে সুভদ্রা। এই দু বছরে তাকে এমন ভাবে সে আবিস্কারই করতে পারেনি কখনও।সেও সুভদ্রাকে নিজের হাতে করে জাপটে ধরলো।সুভদ্রা মনে মনে ভাবলো সে যেন নিরাপদ আশ্রয় পেয়ে গেছে।আর তার ভয় নেই।

সুভদ্রার বাপের বাড়ির স্টেশন এবার এলো বলে।অনুপম সুভদ্রাকে খুব নরম গলায় বললো-

-কী হলো,এখনও মাথা ঘুরছে?

-নাহ..

-কই,এদিকে একবার তাকাও তো দেখি..

সুভদ্রা অনুপমের দিকে তার পাখির নীড় এর মতন নির্মল চোখদুটো তুলে বললো-

-কী?

অনুপম তার পকেট থেকে একটা টিপের পাতা বের করে তার থেকে একটা টিপ তুলে সুভদ্রার কপালে পরিয়ে দিয়ে বললো-

-নীল শাড়িটার সাথে এতক্ষনে তোমায় পরিপূর্ণ লাগছে।

সুভদ্রা তো অনুপমের কান্ড দেখে আহ্লাদে যায় যায়।

-কী?তুমি টিপ এনেছো আমার জন্য?আমি টিপ কপালে দিইনি?

-না তো।তাই তো আনতে গিয়েছিলাম তখন।আরও দুটো জিনিস আছে।

-আরও দুটো জিনিস..কই,কী এনেছো দেখাও..?

অনুপম তার ব্যাগের মধ্যে থেকে দুটো ডালমুটের প্যাকেট আর সেই ডান্ডিওয়ালা পাখাটা সুভদ্রার দিকে বাড়িয়ে দিতে তার আনন্দ তখন আর দেখে কে।অনুপম তার জন্য এসব এনেছে সে যে কল্পনাও করতে পারেনা।স্টেশন ঢুকছিলো ট্রেনটা।সে অনুপমকে কী বলবে কিছু বুঝে উঠতে পারলো না।অনুপম যে তাকে ছেড়ে কোলকাতা চলে যাবে।তাই সে অনুপমকে একবার জড়িয়ে ধরতে চাইলো আবেগী হয়ে।

অনুপম ফিসফিস করে বললো-

-এখন অনেক লোকজন আছে।এটা তোলা থাক।ফিরে এসে হবে না হয়।

সুভদ্রা গোপনে তখন অনুপমের হাতটা চেপে ধরলো।আর বললো-

-তুমি সত্যি অনেক ভালো।অনেক ভালোবাসো না আমাকে। আর আমি পাগলিটা কিছুই বুঝিনা।বুদ্ধু একটা।

-কে বললো ভালোবাসি।তবে বাসবো,যদি এবারে মাস্টার্সটা মন দিয়ে কমপ্লিট করো তবে।

-সত্যি বলছো?

-তিন সত্যি..

-বেশ।আমি সব পারবো।ভালোবাসার জন্য আমি সব পাড়ি।

-এই তো আমার লক্ষী বউ।যাও।আর তাড়াতাড়ি চলে এসো বাড়ি।

-এডমিশন নিয়েই ফিরে আসবো।এবার আর এ বাড়িতে মন টিকবেনা আমার একদিনও।

সুভদ্রা ট্রেন থেকে নেমে গেলো।তার চোখে মুখে তখন সুখের এক অনুভূতি প্রকাশ পাচ্ছিলো।অনুপম হাত নাড়া দিলে পর সুভদ্রা মুখের কাছে হাত নিয়ে এসে তাকে বলে বোঝালো-

-আই লাভ ইউ মিস্টার সেনগুপ্ত।

অনুপমও চোখের ইশারায় সুভদ্রাকে বুঝিয়ে দিলো-

-ইউ টু মিসেস সেনগুপ্ত।

নারী তার কাছের মানুষের থেকে একটু ভালোবাসা পেলে নিজের সবটুকু উজার করে দিতে পারে।আসলে কাছের মানুষের মন বুঝতে হয়।একবার মন বুঝে নিলে সেই মানুষটা তার সবটা দিয়ে তোমায় ভরিয়ে রাখবে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন