প্রীতম সবেমাত্র দুদিন হলো বর্ধমান শহরে এসেছে কলেজে এসিন্টেন্ট প্রোফেসর পদে চাকরিটা নিয়ে।নদীয়ার ছেলে।নদীয়ার বাইরেটা ও চেনেনা।আসলে সত্যি বলতে কী বইয়ের পাতার বাইরের পৃথিবীটাও ও খুব একটা চেনেনা।নতুন জায়গা,তার ওপর জীবনে প্রথমবার ভাড়া বাড়িতে থাকা-এসবটাই কেমন যেন ওর অভ্যেসের বিপরীত পুরো।ওকে নতুন করে সবকিছুটার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে।তারপর...
শহরে থাকার মধ্যে একটা ভালো দিক যেমন যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে প্রয়োজনের সবকিছুটা সহজে মেলে তেমনই আবার তেমনই শহরের বন্ধ ঘর গুলোর বাইরে একটুকরো খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে দুদন্ড শান্তির নি:শ্বাস ফেলার জায়গা নেই।তাই এই দুদিনেই ও কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে উঠেছিলো।মনটা কেমন যেন আনচান করছিলো নিজের গ্রাম বেথুহাডহরির জন্য।যেন কতদিন সে প্রকৃতির আদর পায়নি।ছুঁয়ে দেখতে পারেনি একবিন্দু সবুজের সমারোহ।
দিনটা ছিলো সোমবার।সেদিন কলেজ থেকে বেরিয়ে ওর একটু ইচ্ছে ছিলো বর্ধমান শহরটা ঘুরে দেখবে।কিন্তু অতিথির মত আসা হঠাৎ বৃষ্টিতে তাকে জলদি জলদি করে নিজের রুমে ফিরে আসতে হলো।গ্রামের বর্ষাতে যেভাবে ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে শহরের বৃষ্টিতে সে সৌন্দর্য্য নেই।প্রীতমের বৃষ্টি ভালোলাগে।কিন্তু এই প্রথমবার শহুরে বৃষ্টিপাতের সাথে পরিচয়ের পর তার মনে হয়েছিলো বৃষ্টির উষ্ণতা বোধহয় থার্মোমিটার পরিবর্তন করেছে।
বাড়িতে মায়ের সাথে ফোনে খানিক্ষন কথা বলে সে করলো কী নিজের প্রিয় ডায়রিটা বহুদিনের পর চোখের ওপর খুলে বসলো।কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে তার।কিন্তু কলমটা আর পাতার 'পর ঠেকিয়ে এক লাইনও লেখা বেরোয় না।লিখছে আর কাটছে।বিরক্ত হয়ে পড়েছিলো সে নিজের ওপরেই। খাতা কলম টেবিলের ওপর রেখে দিয়ে কয়েকটা নষ্ট হয়ে যাওয়া পাতা ডায়রি থেকে তুলে দু হাতে ভাঁজ করে জানালার ফোঁকর দিয়ে বাইরে ফেলতে যাবে কী আচমকা পাশের ফ্ল্যাটের ছাদে লক্ষ্য পড়লো,অল্প আলো ও অল্প আবছায়াময় পরিবেশে কেউ একজন বৃষ্টিতে ভিজছে।মুখটা যদিও তার ঠিক মত চেনবার উপায় নেই।তবে তার খোলা লম্বা চুল আর জলে ভেজা পায়ের নুপুরগুলো সে স্পষ্ট দেখতে পেয়ে ছিলো।শহরের মেয়েরাও নুপুর পরে এখনও!বিশ্বাস করতেই
অবাক লাগলো তার।তারপর হঠাৎ বজ্রের আলোয় মেয়েটার রুপোয় ঝলসানো মুখটা প্রীতমের দু চোখের ওপর যেন মায়া দিলো।মনটা তার নিজের অজান্তেই কল্পনার জগতে হারিয়ে গেলো।জানালার পাশেই খাতা কলমটা নিয়ে বসল।
লিখতে আরম্ভ করলো-
-শহরের প্রথম বৃষ্টি দেখছি আজ।আমার গ্রামের থেকে এর অনেক তফাৎ।বৃষ্টির মাঝে সেই নি:স্তব্ধতা নেই।ঝুপ করে নেমে আসা অন্ধকার নেই।ঝিঁঝির ডাক নেই।কিন্তু একটা নতুন অভিজ্ঞতা জন্ম নিয়েছে সদ্য।যা ছাব্বিশ বছরে আর আগে কোনোদিন হয়নি।আমি যে রুমটায় ভাড়া থাকি।এই রূমের দক্ষিন দিকের একমাত্র জানালাটা দিয়ে পাশের ফ্ল্যাটের ছাদটা পরিস্কার দেখা যায়।জানিনা ওপরওয়ালা এ সৌভাগ্যের অধিকার আমায় করলেন কেন।একজন বৃষ্টি কণ্যাকে দেখলাম ওই ফ্ল্যাটের ছাদে আপন মনে বৃষ্টিতে ভিজছে।তাকে বর্ণনা করা আমার সাধ্য না।সত্যি বলতে কী আমি প্রথম দেখায় এই প্রথমবার কোনো মেয়ের ভালো লাগায় পড়েছি।এই মুহুর্তে যে আক্ষেপটা নিয়ে আমি রুমে ফিরে এসেছিলাম।সেই আক্ষেপের ছিঁটে ফোঁটাও নেই এই প্রসন্ন অন্তরে।জানিনা,ওকে আর কোনোদিন দেখবো কিনা।তবে যদি কোনোদিন সামনে আসে অজান্তে,ওকে একবার দু চোখ ভরে দেখবো শুধু।
বৃষ্টি থামার পর লেখাটা শেষ হতে প্রীতম পুনরায় জানালার ধারে উঠে গিয়ে যেখানে সেই মেয়েটাকে দেখেছিলো সেই দিকে খুব আবেগী ভরা দু চোখে তাকালো।মেয়েটা ছিলোন তাও প্রীতমের দু চোখ তখনও যেন শ্রাবণধারা দেখতে পাচ্ছিলো আর সাথে দেখতে পাচ্ছিলো সেই মেয়েটাকেও। অথচ মেয়েটা তখন আর ছাদে নেই।
এই ঘটনার পর আরও দুটো তিনটে দিন প্রীতম অপেক্ষা করেছে জানালার ধারে যদি সেই মেয়েটার একবার দেখা পায়।কিন্তু পায়নি।এই অপেক্ষা জিনিসটা না বড় সুন্দর।কেউ একজন আসবে তার অপেক্ষা-এ যে আলাদাই এক অনুভূতি।
দিন চারেক পর ফের যেদিন ঠিক সন্ধ্যার আগেটায় হঠাৎ করে বৃষ্টি এলো সেদিন মেয়েটাকে সে দ্বিতীয়বার দেখলো। প্রীতম ফের আগের দিনের মতই বৃষ্টিস্নাত অবস্থায় মেয়েটা কে দেখে ডায়রির পাতা খুলে লিখতে বসলো-
-নতুন শহরে আমার দেখা এটা দ্বিতীয় বৃষ্টি।সারাদিন কলেজ আর হিস্ট্রি বইয়ের পাতাগুলোর মধ্যে আটকে পড়া জীবনটায় আজকের বৃষ্টিটা অনেকটা স্বাদ বদলের সংলাপ এর মত।আর উপরি পাওনার মধ্যে পেলাম আগের দিনের সেই বৃষ্টিভেজা মেয়েটাকে।একই রকম ভাবে।পাশের ছাদে। ও আজও বৃষ্টিতে ভিজছিলো খোলা চুলে।ওর মনের উল্লাস আমি আমার অন্তরের সবটুকুদিয়ে যেন অনুভব করতে পারছিলাম।জানিনা মেয়েটা কে,কী নাম তার।শুধু এতটুকুই বলতে পারি,ওর শহুরে হৃদয়ে গ্রামের মাটির ছোঁয়া আছে। কখনও আমাদের আলাপ হবে কি না জানিনা।কিম্বা হঠাৎ কোনো দিন যদি ও সামনেও চলে আসে তাহলে আমার যে কী অবস্থা হবে ভাবতেই...।
সেই রাতে আর বৃষ্টি থামলো না।প্রীতম রুমের জানালাগুলো হাট করে খুলে রেখে মেয়েটার কল্পনায় হারিয়ে গেলো।সে নিজেও বুঝতে পারছে না,তার কেন এমন হচ্ছে।যতবার সে চোখ বন্ধ করছে সেই মেয়েটাই বা কেন বন্ধ চোখের পাতায় গোধূলির ধ্রুবতারার মত ভেসে উঠছে।শুধু মনের মধ্যে এক গভীর প্রশান্তি অনুভব হচ্ছে আর একই সাথে ছটফটানিও।
এই ঘটনার আরও দিন দুয়েক পর।প্রীতম স্টাফরুমে বসে বসে গভীর মনযোগের সাথে মারাঠাদের ইতিহাস পড়ছে। ক্লাস আছে একটা প্রিয়ডের পর।মারাঠা বীর শিবাজির গল্প তো কম বেশি সবাই জানে।কিন্তু শিবাজির একজন বিশ্বস্ত যোদ্ধা ছিলো সদাশিব।তার কথা আর কতজনই বা জানে।পড়তে পড়তে হঠাৎ প্রীতমের মনের মধ্যে ভেসে উঠলো সেই সদাশিব আর কুমকুমের ভালোবাসার কাহিনীটা।ভালোবাসা যে কী অদ্ভুৎ বস্তু,সত্যি তার কোনো ব্যখ্যা হয়না।কত বছর দূরে চলে গিয়েও ফের কাছের মানুষটার টানে ফিরে আসা যায় তা যেমন বুঝিয়েছিলো সদাশিব তেমনই কুমকুম গল্পের শেষে প্রমাণ দিয়েছিলো ভালোবাসা সত্যি হলে ভালোবাসার
মানুষটাকে ঠিক ফিরে পাওয়া যায়।ইতিহাসের পাতা থেকে এই ছোট্ট প্রেমকাহিনীর কথা মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করে উঠতে প্রীতমেরও চোখের ওপর অজান্তে ঠিক স্বপ্নের মত জ্বলজ্বল করে উঠলো বৃষ্টিস্নাত সেই মেয়েটার কথা।যেই মেয়েটা প্রীতমের নরম কাদামাটির মত অন্তরে বসন্তের প্রথম ফুলটা ফুটিয়ে ছেড়েছে।
হঠাৎই কয়েকজন পড়ুয়ার কন্ঠে প্রীতম যেন বাস্তবে ফিরে
এলো।সে খানিক ইতস্ততভাবে বলে উঠলো-
-হ্যাঁ,কি হয়েছে..
-ভেতরে আসবো স্যার?
-এসো এসো..
হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্টরা স্টাফরুমের ভেতরে প্রবেশ করে প্রীতমের সামনে এসে একটা অনুরোধ রাখলো-
-স্যার,এবারের ওয়াল ম্যাগাজিনে আপনাকে কোনো লেখা দিতে হবে।
-আমাকে?
-হ্যাঁ..আমরা আপনার ফেসবুক একাউন্ট দেখেছি।আপনি বেশ ভালো ভালো লেখা দেন ওখানে।তাই আমরা চাই এই বছর হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট থেকে যে ওয়াল ম্যাগাজিন প্রকাশ করা হবে সেখানে আপনি কোনো একটা লেখা দিন।
অগত্যা ছাত্রছাত্রীদের যাচাযাচিতে প্রীতম আর না করতে পারলোনা।সে কথা দিলো যে তার নিজের একটা লেখা সে দেবে ওয়াল ম্যাগাজিনের জন্য।
হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের সিনিয়ররা মোটামুটি দুদিনের মধ্যে যে যা লেখা দিয়েছে তা সংগ্রহ করে তাদের ডিপার্টমেন্টের এক্স ছাত্রী,ইশারা মন্ডলকে ফোন করলো।
-হ্যালো দিদি,চিনতে পারছো তো?
-হ্যাঁ,সুবিমল বলো..
-আমি ফোনটা স্পিকারে রাখছি।ডিপার্টমেন্টের অনেকেই আছে এখানে।
-বেশ।বলো।
-এবারের ওয়াল ম্যগাজিনটা কিন্তু তোমাকেই করে দিতে হবে দিদি প্রতিবারের মত।
-এই,এবারটা আমায় ছেড়ে দাও।
-ওসব বললে হবে না।আর সবাই চায় তোমার হাতের লেখা তে জাদু আছে।তাই তোমাকেই করে দিতে হবে।
অবশেষে ইশারা মন্ডলের কোনো কিছু এক্সকিউজই কাজে এলো না।ফোন রাখার আগে ইশারা মন্ডল সুবিমলকে বলল
-ঠিক আছে..পরশু দিন সবাই থেকো।আমি ডিপার্টমেন্টে আসছি।
ইশারা মন্ডল রাজি হয়েছে জানবার পর আশে পাশে যে দু দশজন ছিলো তারাও ইশারা মন্ডলকে -'থ্যাংক ইউ দিদি' বলে উঠলো একসাথে।
দিনটা ছিলো বুধবার।হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট সেদিন গমগম করছে।প্রীতম ক্লাসে ঢুকে এত স্টুডেন্টের উপস্থিতি দেখে তো অবাক।সে প্রেজেন্ট শেষ করে হাসি মুখে জানতে চাইল
-কী ব্যাপার,আজ কী কোনো বিশেষ দিন টিন আছে নাকি। এত সবাই মিলে এসেছো?
তিনটে ইয়ারের স্টুডেন্টদের থেকে সে জানতে পারলো ওই একটাই নাম।ইশারা মন্ডল।সে নাকি আজ কলেজে আসবে তাই সকলের এহেন আগমন।প্রীতম ভাবলো,ইশারা মন্ডলটা আবার কে।যার জন্য স্টুডেন্টদের মধ্যে এত উত্তেজনা।তাই সেও গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো অচেনা অজানা ইশারা মন্ডলকে একবার দেখবার জন্য।দুপুরের দিকে ইশারা মন্ডল কলেজে এলো।এই কলেজেই একদিন সে আসতো।কত স্মৃতি ঘেরা সবকিছুটা।নিজের কলেজের দরজা পেরোনো মাত্রই ইশারার বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো।
পুরো হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট এক জায়গায় একত্রিত হলো।শুধু মাত্র ইশারা মন্ডলকে দেখবার জন্য।যতই হোক বর্ধমান শহর টা ইশারা মন্ডলকে খুব ভালো করে চেনে একজন ভালো শিল্পী হিসেবে।আর যার এত নাম শহরজুড়ে,তাকে একবার চোখের দেখা দেখতে আসবে না তা কি হয়।
মোটামুটি ইশারার সাথে ডিপার্টমেন্টের নতুন স্টুডেন্টদের আলাপ পরিচিতির পর ইশারা বেশ কয়েকজন স্টুডেন্টদের নিয়ে ওয়াল ম্যাগাজিন সংক্রান্ত আলোচোনায় বসেছে।ঠিক তখনই প্রীতমের উদয় হলো।আর আসা মাত্রই ইশারার সঙ্গে প্রীতমের দৃষ্টি হলো।প্রীতম তাকে আগে কখনও দেখেনি।তাও তার চোখে চোখ পড়া মাত্র তার কেমন যেন মনে হলো ওই বড় বড় গোল দুটো চোখ তার খুব চেনা।
প্রীতম ইশারার চোখের দিকে তাকিয়ে এক মুহুর্তের জন্য বিহ্বল হয়ে পড়ল।পৃথিবীর সমস্ত ঘড়ির কাঁটা যেন থমকে গিয়েছিলো সেই চোখেদের পাতা ভরা উপন্যাসে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন