Breaking

রবিবার, ডিসেম্বর ৩

দার্জিলিং মেইল








বেশ কিছুক্ষন ধরেই মনে হচ্ছিলো যে ট্রেনটা এবার ছাড়লে হয়।সারাদিন জার্নির পর শিয়ালদা স্টেশনে অত মানুষের জটলা আর আমার শ্রবণযন্ত্রটি নিতে প্রস্তুত ছিলো না।তাই ক্রমেই বিরক্ত হচ্ছিলাম আমি।


তাও দার্জিলিং মেইল সময়ের চেয়ে বারো মিনিট পরে হাঁটতে শুরু করলো।আমার সীট লোয়ার বার্থএ ছিলো।সামনের সীটে তখনও কোনো প্যাসেঞ্জারের চিহ্ন নেই দেখে আমি পা থেকে বুটের দড়ি জোড়া খুলে সামনের সীটে পা টা তুলে দিয়ে আরামকেদারা তে বসার মত খানিক হেলান দিয়ে ইয়ারফোনটা দু কানে লাগিয়ে একটু রিল্যাক্সের ভঙ্গিমায় জাস্ট চোখ দুটো বুজিয়েছি..মিনিট খানেকের মধ্যে কানে বেজে চলা হিন্দি গানের মিষ্টি মধুর সুর ভেদ করে কারও একজনের কন্ঠস্বর যেন বিঁধে গেলো।সেই কারনে আপনা আপনিই সবে শীতলতার স্পর্শ পাওয়া দু চোখের পাতা ফের উন্মুক্ত হলো।আর তা খোলা মাত্রই চোখের মণিতে ফের বিরক্তির পরিবর্তে জন্ম নিলো এক অজানা ভালোলাগা।সেই ভালোলাগাটারই যেন আমি জীবনে কখনও সম্মুখীন হয়নি।সে যেন হঠাৎ লাভ করা কোনো স্বপ্ন।

আমার পলকের সামনে দাঁড়িয়ে তখন একটা বছর বাইশ তেইশেকের চলচিত্রের নায়িকা।নায়িকা বললে ও বোধহয় কম বলা হবে তেমনই সে।আমায় তার কাজল কালো চোখের ইশারায় বলল-(পা টা একটু নামান।আমি বসবো)আমি থতমত খেতে খেতে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমার পাদুটো নামিয়ে ফেলে গায়ের টিশার্টটা ঠিকঠাক করে একদম সোজা হয়ে বসলাম।

মেয়েটা নিজের সাথে যে ব্যাগটা এনেছিলো সেটা জানালার দিকে সীটের ওপর রেখে একবার মাথার চুলটা ঠিক করে,দু একবার আলতো আঙুলে ঠোঁটের নীচে ও মুখের অন্যান্য অংশের তেলতেলে ভাবটা মুছে সীটে বসলো।তারপর ব্যাগের সাইড থেকে জলের বোতল বের করে কয়েক ঘোট জল খেলো।

আমার ওপরের সীটের যাত্রীরা বোধহয় রাতের খাবার খেয়েই ট্রেনে উঠেছিলো তাই তারা কেউই বেশি দেরী করতে চাইলোনা শরীরটা এলিয়ে দিতে। কিন্তু,আমার তো ডিনার হয়নি।আবার এদিকে মিডিল বার্থটা বিছিয়ে দেওয়ার জন্য আমি ঠিকমত বসতেও পারছিলাম না তো খাবো কীকরে!তাই বাধ্য হয়ে আমায় সামনের সীটে বসে থাকা ওই মেয়েটাকে বলতে হলো-

-'আপনার কী জানালার দিকে কিছুক্ষন সরে বসলে অসুবিধে হবে?'

মেয়ে ফেসবুকে ব্যস্ত ছিলো।আমায় কিছু বললো না। শুধু জানালার দিকটা ছেড়ে অন্যপাশে গিয়ে বসলো।
আমি তবু একটা-'থ্যাংক্স' জানালাম।আর্ধেক খাবার খাওয়ার পর খেয়াল পড়লো আমি জলের বোতল কিনবো বলে কেনা হয়নি।আর ট্রেনেও ওঠা থেকে কোনো জলবিক্রেতাকে দেখিনি।
উপায়?
জল তো চাই ই..নইলে..।কি জানি,মেয়েটা হয়তো আমায় খেয়াল করছিলো।তাই আমার না চাওয়ার সত্ত্বেও সে দেখি আমার দিকে তার জলের বোতলটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল-

-'আপাতত নিতে পারেন।আমার কাছে এক্সট্রা আর একটা আছে।'

আমি নেবো কি নেবোনা করে নিয়েই ফেললাম।আর ফের তাকে বললাম-'থ্যাংক্স।' 
মেয়েটা মুখে না বললেও হাবভাবে বোঝালো-(ঠিক আছে)
আমি তখন সৌজন্যে বজায় রাখতে জানতে চাইলাম-

-'আপনি খাবেন না?'

-'এত সকাল তো খাইনা কোনোদিন।'

-'আচ্ছা।আমাদের গ্রামের দিকের মানুষজনের তো এতক্ষনকে খেয়ে একঘুম হয়ে গেলো।'

-'আপনি গ্রামে থাকেন?'

-'না এখন থাকিনা।কাজের জন্য শহরেই থাকতে হয়। এইচ এস পর্যন্ত ওখানেই ছিলাম।'

মেয়েটা সেইমুহুর্তে আর কিছু বললোনা।খানিক্ষন দু জনেই চুপ থাকবার পর আমিই প্রশ্নটা করলাম-

-'আপনি কোথা থেকে?'

-'আমি?আমি ধূপগুড়ি থেকে।স্যুট ছিলো তাই এই আপনাদের কোলকাতায় এসেছিলাম।'

-'স্যুট মানে?আপনি কী সিনেমা ইত্যাদির সাথে যুক্ত নাকি?'

-'ফোটো স্যুট।আমি একজন মডেল।মডেলিং করি।'

'মডেলিং করি' কথাটা মেয়েটার মুখে শোনার পরই আমার ঠোঁটে না আটকে কথাটা বেরিয়েই গেলো-

-'তাই এত সুন্দর আপনি।'

মেয়েটা শুনেও যেন না শোনার ভান করে বললো-

-'কী?'

আমি সামলে নিয়ে কথাটা সামান্য ঘুরিয়ে বললাম-

-'আপনাকে দেখেই মনে হয়..'

এটাই বললাম আর কি।মেয়েটা তৎক্ষনাৎ বললো-

-'তাই?'

-'আমি কেন যে কেউ বলবে।'

-'থ্যাংক্স।'

-'শুভেচ্ছা'

-'তা আপনি কি করেন,কৈ বললেন না তো?'

-'আমি এইচ ডি এফ সি তে আছি।'

-'ব্যাংক জব।বাহহ..'

-'আপনি কি প্রোফেশনালই মডেলিং করেন নাকি অন্যকিছুও করেন?'

-'করি তো অনেক কিছুই।টাকার জন্য কত রকমের কত কি করতে হয়।তবে মডেলিং টা আমার প্যাশন।ভালোলাগাকে ভালোলাগাও হলো,রোজগারও হলো।

-'যেমন আর কি কি করেন?'

-'টিউশন পড়াই।বুটিকে পার্ট টাই জব করি।আপনি হয়তো ভাবছেন এতকিছু করার প্রয়োজন কি?কিন্তু
কি জানেন তো,টাকার প্রয়োজন সবার।কার নেই বলুন না।'

-'তাও,আপনার এত প্রয়োজনটা কীসের?নিজের স্বপ্ন পূরণই কি এর কারন?'

মেয়েটা হঠাৎ এবার হাসলো।তারপর বললো-

-'আধঘন্টার আলাপে এত সব জেনে নেবেন?'

-'একান্ত অসুবিধা না থাকলে শেয়ার করতে পারেন। হ্যাঁ,এটা সত্যি যে সম্পূর্ণই অপরিচিত আমরা..।'

মেয়েটা কয়েক মুহুর্ত চুপ থেকে বলতে শুরু করলো-

-'বাবা ব্যাবসায় ডুবে আছে।মেয়ে হলেও তো বাবার সন্তান।যতটা পারি যেভাবে পারি বাবাকে ভরাডুবি থেকে তুলতে চেষ্টা করছি।নিজের স্বপ্ন দেখার সময় নেই।'

মেয়েটার এই ব্যথাগুলো শোনার পর আমার মনের ভেতরটা হঠাৎই যেন ওর জন্য কেমন যেন সহানুভূতিতে ভরে উঠলো।আবার এটাও ভেবে ভালো লাগলো যে মেয়েটার ডেডিকেশন কতখানি তার ফ্যামিলির প্রতি।আমি সে মুহুর্তে সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে গেলে মেয়েটা বলে উঠলো-

-'কী হলো,আমার জীবনের গল্প শুনে কথা বলা বন্ধ করে দিলেন যে। আরে আমি দুঃখ পুষে রাখিনা মনের ভেতর।আপনি এত ভাববেন না।'

আমি অন্যমনস্কতা কাটিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বললাম-

-'না না..আচ্ছা,এবার খেয়ে নিন।আমি আমার সীটে যাই।'

মেয়েটা বলল-

-'ঘুমিয়ে যাবেন নাকি এখনই?'

-'এত তাড়াতাড়ি নয়।'

-'তবে?চাইলে বসতে পারেন।বর্ধমান আসতে তো এখনও অনেক বাকি।এদিকের সীটগুলো তো ফাঁকাই থাকবে ততক্ষন।'

আমি আর উঠলাম না।দক্ষিনেশ্বরের মন্দির সবেমাত্র পেরোলো ট্রেনটা।আমি মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম

-'মায়ের মন্দিরে এসেছেন কোনোদিন?'

-'না,এই ট্রেন থেকেই যা দেখেছি।'

-'একবার আসবেন।ভেতর থেকে দেখবেন প্রশান্তি অনুভব করবেন।'

-'ইচ্ছা অনেকদিন ধরেই আছে।দেখি,আবার দেবী মা কবে নিজের কাছে টানান আমায়।'

-'হুম..পরের বার যখন আসবেন।তখন দেখে যাবেন। তা কোলকাতায় কী কী দেখলেন?'

-কোলকাতায় আর কী?ওই রবীন্দ্র সরোবরের স্যুট হচ্ছিলো,ওটাই।কালই তো এসেছিলাম আবার আজ ফিরে যাচ্ছি।তবে রবীন্দ্র সরোবরের পরিবেশটা বেশ ভালো।আচ্ছা,ওটা কী প্রেমিক প্রেমিকাদের জন্যই?'

আমি হাসলাম।হাসতে হাসতেই বললাম-

-'তা যা বলেছেন।'

-'আপনি তো কোলকাতাতেই থাকেন।তাহলে প্রায়ই যান তো?'

-'আমি দু একবার গেছি।তবে আমি প্রেমবিরোধী মানুষ।ও জায়গা আমার নয় সেটা বুঝেছি।'

-'প্রেম বিরোধী বলছেন কেন?ভালোবাসা কী দোষ করলো?'

-'ওসবে আবার থাকে নাকি।বন্ধুদের দেখি তো।সারা দিন শুধু...কী যে পায়..'

-'আপনি কোনোদিন কারোর প্রেমে পড়েননি?'

-'মেয়ে দেখলেই তাদের চেয়ে দশহাত দূরে থাকতাম'

-'এখন তো দুহাতের দূরত্বও নেই।আমি কী মেয়ে নই, নাকি..?

মেয়েটা হালকা হাসলো।আমি ভেতর ভেতর লজ্জা পেলাম।আর সেই হেতুই হয়তো জানালার দিকে সরে
যেতে চেষ্টা করলাম।মেয়েটা আমার ভাবভঙ্গিমা খানা দেখে শীঘ্রি বললো-

-'সরি..মানে ও ভাবে বলতে চাইনি আমি।কেন মেয়েদের থেকে দূরে থাকলে বললেন না তো?'

আমি এবার আগের মত অতটা না হলেও স্বাভাবিক ভাবেই বললাম-

-'আনকম্ফোর্টেবেল লাগে।'

-'কীসের অস্বস্তি আবার এতে?হাসালেন....কী,যদি কেউ প্রেমে পড়ে যায় এই ভয়?'

হাসলাম।এ হাসিটা খানিক সম্মতির হাসি।তারপরে বললাম-

-'আমি অতটা স্মার্ট নই যে যে কেউ মেয়ের আমাকে ভালোলেগে যাবে অত সহজে।'

-'অতটা বোকাবোকাও তো নন।সবসময় স্মার্টনেশ দেখেই কী মেয়েরা প্রেমে পড়ে?আপনাকে যদি বলি আপনি একজন মেয়ের কী দেখে প্রেমে পড়বেন?'

এই প্রথমবার আমার ঠোঁটের শব্দ কেমন যেন এলো মেলো হয়ে যেতে লাগলো।

-'কী দেখে..মানে.. কী আর দেখে..এই ধরুন..অন্তর দেখে..'

-'অন্তর দেখা যায় বুঝি?'

আমি এর কী উত্তর দেবো না খুঁজে পেয়ে (আসছি একটু) বলে উঠে চলে গেলাম সোজা দরজার কাছে।
একজন দেখি দরজার সামনে বসেই সিগারেটে টান দিচ্ছে।তাকে দেখে আমারও সাহস হলো।আমিও সিগারেট ধরালাম তবে সেটা টয়লেটের ভেতরে গিয়ে।ভয় তো আছে।তবে লুকিয়ে সিগারেট ধরানোর ভয় অপেক্ষা তখন আমার কাছে বেশি উদবেগের কারন হয়ে উঠেছিলো ওই মেয়েটা।আমি কেমন করে যেন মেয়েটার প্রতি ইনফ্যাটুয়েশনে পড়ে গিয়েছিলাম আর সেটা আমার অজ্ঞাতেই।

সিগারেটটা আর্ধেক শেষ করে ফেলে দিয়ে আমি আবার নিজের জায়গায় ফিরে আসলাম।সেইমাত্র বর্ধমান ঢুকবে ঢুকনে করছে ট্রেনটা।কখন যে এতটা সময় কথার ফাঁকে পাড় হয়ে গিয়েছে বুঝতেই পারি নি।মেয়েটা দেখি নিজের সীট ছেড়ে উঠে পড়লো।আমি না জিজ্ঞেস করে থাকতে পারলাম না-

-'কোথায় উঠলেন?'

-'এটা তো আমার সীট নয়।তো এবার তো আমায় উঠতেই হবে।'

অবাক হওয়ার মত কথা।আমি ভীষন অবাক হলাম।

-'মানে?'

-'এতক্ষন আমি আপনাকে একটা গল্প বলছিলাম।
নমস্কার,আমি রাতৈরী সেন।খুব সাধারন বাড়ির মেয়ে।গল্প লিখি।আপনি স্বপ্নের কথা বলছিলেন না।
আমি লেখিকা হওয়ার স্বপ্ন দেখি।আমি সেইসব মেয়েদের গল্প লিখি যারা সমাজে নিজের পরিশ্রমে
নিজের জায়গাটা করে নিয়েছে।কেমন লাগলো আপনার গল্পটা?'

আমার তখন কী বলা উচিত আমি বুঝে উঠতেই পারছিনা।বাস্তবে আছি নাকি স্বপ্নে তাও বোধগম্য
হচ্ছে না।শেষমেষ কি জানি কি খেয়ালে মনের গোপন ইচ্ছেটা বলেই ফেললাম-

-'আপনাকে যে আমার ভালোলেগে গেছে।'

মেয়েটা কিছু বলতে যাচ্ছিলো।এমন সময় বর্ধমানে ট্রেন এসে পড়ায় মেয়েটাকে বাধ্য হয়ে দরজার দিকে
এগিয়ে যেতে হলো।আমি মেয়েটার উত্তরটা শুনবো বলে তার দিকে প্রায় দৌড়ে গেলাম বাইরে থেকে সদ্য
আসা যাত্রীদের ভীড় ঢেলে।মেয়েটার নাগাল আমি আর পেতে পারলাম না।শুধু ওদিক থেকে একবার
শুনতে পেলাম-

-'আমি বর্ধমান শহরেই থাকি।অপেক্ষা করবো।'

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন