শুক্রবার, অক্টোবর ১৩

খুশিগঞ্জে







দাদা,কটায় ছাড়বে?

বাস কনডাক্টরটি তার হাতঘড়িটা একবার দেখে নীলাঞ্জন কে জানালো-
-বারোটা পাঁচ...
নীলাঞ্জন দেখলো তার হাতে তখনও পনেরো মিনিট সময় রয়েছে।সে বাসে উঠে কাঁধের ব্যাগটা একটা ফাঁকা সীটে রেখে বাস স্ট্যান্ডের একেবারে সামনের একটা দোকানে গিয়ে একটা সিগারেট নিয়ে জ্বালালো।তিন বছর পর সে ব্যাঙ্গালোর থেকে বাড়ি ফিরছে।আসার যে খুব একটা বড় ইচ্ছে ছিলো তা নয়।ছোটো বেলাকার বন্ধু রাকেশের বিয়ে।তাই দেশের বাড়ি আসা।
সিগারেটটা শেষ করে সে যখন বাসের সামনে গিয়ে দাঁড়াল তখনও মিনিট পাঁচেক সময় বাকি বাস ছাড়তে।নীলাঞ্জনের ভীড় একেবারে পছন্দ নয়।এক তো লোকাল ট্রেনে ভীড় পেয়েছে।এবার যদি বাসেও ওই একই রকম ব্যাপারটা হয় তো..
বাস ড্রাইভার বাসে উঠে বাস ছাড়বার হর্ণ দিলো।নীলাঞ্জন কানে ব্লুটুথ হেডফোনটা লাগিয়ে নিয়ে তাতে অরিজিৎ সিং এর প্লে ট্র্যাক চালিয়ে ভেতরে গিয়ে দেখে তার ব্যাগের পাশে আর একটা অন্য কারোর ব্যাগ রাখা।যার ব্যাগ তখনও সে আসেনি।নীলাঞ্জন ভাবলো- আমার কী,যার ব্যাগ সে বুঝবে।
বাস প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলো।নীলাঞ্জন জানালার পাশের সীটটায় বসে মুখে রুমাল বেঁধে চোখে চশমা লাগিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলো স্ট্যান্ড থেকে বাসটা ছাড়লে হয়।আচমকা বাসের চাকা কয়েকবার গড়িয়ে ব্রেক এর কারনে সামনের দিকে একটা ঝাঁকুনি মত দিয়ে বাসটা থেমে গেলো।আর তখনই নীলাঞ্জনের কানে গানের ভলিউম ভেদ করে একটা মেয়ের গলা মৃদু ভাবে কর্ণপটহের মধ্যে প্রবেশ করলো।ফিরে দেখে মেয়েটা কনডাক্টরের সাথে পা বেঁধে ঝগড়া করছে।
-কেন আপনি সময়ের আগে বাস ছাড়বেন...? আমার ব্যাগ ছিলো বাসে..কী হত? কীভাবে বাড়ি ফিরতাম আমি..কত কী
কনডাক্টরটি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে-
-বাসটা স্ট্যান্ডের মুখ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো।ওখান থেকে সময়েই ছাড়তো।
কিন্তু সে মেয়েতো বুঝবেনা।আনাড়ির মত তর্ক করে যাচ্ছে। নীলাঞ্জন একবার ফোনের স্ক্রিনে সময়টা দেখলো। বারোটা সতেরো।তা ঠিক সময়েই তো ছেড়েছে।মেয়েটারই বোধহয় অমন ঝগড়ুটে স্বভাব।দেখতে সুন্দর হলে হবে কী ব্যবহার মোটেও তার ভালো না।এসব ভেবে সে ফের জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে গানের ভলিউম টা বাড়িয়ে গানে মগ্ন হলো।

কথাকাটাকাটি থামলে পর মেয়েটা এসে তার ব্যাগটা নিয়ে সীটে বসে পড়লো।আর বসবি তো বস,নীলাঞ্জনের পাশের সীটটায়।কী অবস্থা!নীলাঞ্জন তো তাকে পাশে বসতেই দেখে আগের চেয়ে আরও সোজা হয়ে নিজের সীটে বসলো।বাস স্ট্যান্ড থেকে ছাড়লো।মেয়েটার মাথায় তখনও আগুন জ্বলছে।ফোন এলো ওর একটা।সে ফোনটা রিসিভ করে ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা মানুষটাকে বেশ জোর গলাতে-
-দেখনা..বাসে ব্যাগটা রেখেছিলাম..এদের কোনো দায়িত্ব নেই যে কে এলো না এলো দেখবার ইত্যাদি ইত্যাদি..
মেয়েটার কথাগুলো বেশ ভালো মতই কানে যাচ্ছিলো নীলাঞ্জনের।সে বিরক্ত বোধ করলো।একটা কান থেকে হেড ফোনের কড খুলে সে মেয়েটাকে বললো-
-এত শব্দদূষন করছেন কেন আপনি..?একটু শান্ত হয়ে বসুন না..
মেয়েটার মাথা এমনিতেই চটে ছিলো।সে ছেলেটার কথাটা শুনে যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো।
-কী..?আমি শব্দদূষন করছি...?
-হ্যাঁ,তবে না তো কী,উঠে থেকেতো তাই করছেন..
মেয়েটা এবার নীলাঞ্জনের সাথে প্রায় ঝগড়া শুরু করে দিলে পর নীলাঞ্জন কন্ডাকটরকে ডেকে বললো-
-আমাকে একটা অন্য সীটে বসবার ব্যবস্থা করে দিন না..
কনডাক্টরটি এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো বাসের সব সীট ভর্তি।
-অন্যকোথাও তো ফাঁকা নেই..এখানে কী কোনো সমস্যা হচ্ছে আপনার?
-সমস্যাকে ঘাড়ে করে নিয়ে বসে আছি আর...
অস্ফুট সুরে কথাটা বললো নীলাঞ্জন।সে যে কাকে সমস্যা বলে সম্বোধন করলো সেটাও ভালো করে বুঝলো মেয়েটা।
-আমাকে যদি আপনার সমস্যা মনে হয় তো উঠে গিয়ে অন্য কোথাও বসুন না..
-সেটাই তো চেষ্টা করছি...
নীলাঞ্জনের কিন্তু অন্যত্র উঠে যাওয়ার সৌভাগ্য হলোনা।অগত্যা, বাকি রাস্তাটা তাকে ওই ঝগড়ুটে মেয়েটার পাশে বসেই যেতে হবে এটা মেনে নিলো নীলাঞ্জন।
নীলাঞ্জনের ভীষন জলতেষ্টা পেয়েছিলো।চলন্ত বাসে জল খাওয়াটা বিপদ।তাই সে বাসটার থামবার অপেক্ষা করছিল বেশ কিছুক্ষন ধরে।বাসটা একটা স্টপেজে থামলে পর সে ব্যাগ থেকে জলের বোতলটা বের করে সবে ছিপিটা খুলে গলা ভেজাতে যাবে অমনি বাসটা একটা ছোট্ট ঝাঁকুনি মত দিয়ে ছেড়ে দেওয়ার কারনে কেলেঙ্কারিটা নীলাঞ্জনের দ্বারা ঘটেই গেলো।জলের বোতল চমকে গিয়ে খানিকটা জল মেয়েটার হাতে থাকা সেলফোনের ওপর।সেই কান্ড ঘটে যেতে জলের বোতল হাতে মুখ হাঁ অবস্থাতে আড়চোখে তা দেখে নীলাঞ্জন তো পুরো থ।আর ওদিকে মেয়েটাও পুরো থ।তার মাথায় আগুনের পিন্ড জমতে শুরু হয়েছে।এই বুঝি ফেটে পড়লো বলে।নীলাঞ্জন তা অনুভব করে পকেট থেকে তার রুমালটা বের করে সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটার হাতের ফোনটা নিজের হাতে নিয়ে সেটার স্ক্রিনটা মুছতে শুরু করে দিলো।মেয়েটা চোখ বড় বড় করে মুখ লাল করে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে-
-মানে আপনি...আমার নতুন ফোনটায়..
-সরি ম্যাডাম..আই এম এক্সট্রিমলি সরি..এইতো কিচ্ছু হয়নি দেখুন...
-আপনাকে আমি খুন করে ফেলবো যদি আমার ফোনটার কিছু হয়...
কথাটা বলতে বলতে নীলাঞ্জনের হাত থেকে ফোনটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে ফোনটা ভালো করে চেক করতে শুরু করে দিলো।নীলাঞ্জন ফের পাশ থেকে বললো-
-দেখুন না কিচ্ছু হয়নি...আমি তো জেনে বুঝে করিনি..
-না আপনি জেনে শুনেই করেছেন..আমার ওপর নিজের রাগ ঝাড়তে..
নীলাঞ্জন গলায় হাত দিয়ে-
-আপনার দিব্যি..ইয়ে মানে আমার দিব্যি...
-আপনার দিব্যি নিয়ে কী আমি ইয়ে করবো...যত সব..
যাক ফোনটার কিছু ক্ষতি হয়নি দেখে মেয়েটা অনেকটা শান্ত হলো।নীলাঞ্জন মনে মনে ভাবলো মা ভবানী বোধহয় এ যাত্রায় শান্ত হয়েছেন।এরপর থেকে মেয়েটা নীলাঞ্জনকে আড় চোখে চোখে লক্ষ্য রাখছিলো যে সে আর কিছু চেষ্টা করছে নাকি।পরের বার সে যখন ফের তার জলের বোতলটা বের করলো মেয়েটা আগেভাগে তার ফোনটা সরিয়ে নিলো।নীলাঞ্জনের তা চোখ এড়ায়নি।
কনডাক্টর বাসের ভাড়া নিতে এলো।প্রথমে মেয়েটাকে চাইলো-
-দিদি আপনার ভাড়াটা..
মেয়েটা ভাড়া দেবে বলে ব্যাগ খুলে পার্সটা বের করতে গিয়ে দেখে- সর্বনাশ!পার্স কোথায়? তবে কী যে দোকানে ল্যাহেঙ্গা কিনতে গিয়ে ছিলো সেখানে ফেলে এলো নাকি?
-কই দিদি দিন ভাড়াটা..
মেয়েটাকে ফের একবার ভাড়া চেয়ে কনডাক্টরটি নীলাঞ্জনকে ভাড়া চাইতে সে একটা একশো টাকার নোট বের করে তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে-
-একটা খুশিগঞ্জ...
কনডাক্টরটি নীলাঞ্জনের কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে বললো-
-ভাঙানি নেই...সামনের ভাড়াগুলো কেটে ফেরত দিচ্ছি..
ওদিকে মেয়েটা তখনও তার পার্স খুঁজে যাচ্ছে ব্যাগের মধ্যে তন্নতন্ন করে।না কোথাও নেই।তিন হাজার টাকা ছিলো তার পার্স এ।এখন বাসভাড়া দেবে কীকরে সে? নীলাঞ্জন পাশ থেকে সব দেখছিলো।সে বুঝলো মেয়েটার কাছে টাকাপত্র নেই।
-কী ব্যাপার,ভাড়ার টাকা নেই বুঝি?
মেয়েটা অন্যমনস্কভাবে নীলাঞ্জনকে উত্তর দিয়ে বসলো-
-না..পার্সটা যে কোথায় গেলো খুঁজেই পাচ্ছিনা..
তারপরমুহুর্তেই যখন খেয়াল পড়লো সে নীলাঞ্জনকে সত্যি কথাটা বলে ফেলেছে তখন চোখ বন্ধ করে ইসস..কথাটা তার মুখ দিয়ে প্রকাশ পেলো।
-এত দামী ওয়ান প্লাসের ফোন নিয়ে বেরিয়েছেন আর এই সামান্য বাসভাড়াটা সাথে নেননি..
-এই আপনি চুপ করুন তো..আপনাকে জ্ঞান দিতে বলেছি আমি.. আপনাকে তো আর আমার ভাড়াটা দিতে বলছিনা..
-ঠিক আছে...
বলে মনে মনে নীলাঞ্জন একবার হেসে নিয়ে আড়চোখে মেয়েটাকে একবার দেখে সোজা হয়ে বসে গান গুনগুন করতে লাগলো..।
মেয়েটা এক তো টাকা পাচ্ছেনা তার ওপর নীলাঞ্জনের হেঁড়ে গলার গান..উফফ যেন সহ্য হচ্ছিলো না তার।সে টাকা খোঁজা বন্ধ রেখে আগে ছেলেটার দিকে পাশ ফিরে-
-এই আপনি আপনার এই অসয্য গলার গান বন্ধ করুন তো জাস্ট ইনকরিজেবল...
-উফফ আপনি এত রাগছেন কেন?কত মন দিয়ে অরিজিৎ এর গানটা গুনগুন করছি..আপনার সবেতে সমস্যা..
মেয়েটা এবার দাঁতে দাঁত চেপে রাগে লাল হয়ে আঙুল তুলে নীলাঞ্জনকে গালাগালটা দিতে যেয়েও থেমে গেলো।
-এমা গালাগাল দিতে যাচ্ছিলেন নাকি..
-আপনি চুপ করবেন...প্লিজ..
-এই দিন না দিন না..মেয়েদের মুখে অনেকদিন গালাগাল শোনা হয়নি...দিন না..
এই সময় কন্ডাকটরটি খুচরো নিয়ে হাজির।সে ফেরতের টাকাটা দিতে নীলাঞ্জনের দিকে হাত বাড়িয়েছে নীলাঞ্জন চোখের আর হাতের ইশারায় তাকে বললো-
-এনারটাও কেটে নিন।
কন্ডাকটরটি দুজনের ভাড়া কেটে টিকিট আর বাকিটা নীলাঞ্জনকে ফেরত দিলো।মেয়েটা তখন কন্ডাকটর এর দিকে চাইছেও না।যদি ভাড়া চেয়ে বসে।যাক সে চলে গেলে পর খানিকটা নিশ্চিন্ত হলো।ভাবলো সে হয়তো ভুলে গেছে।
অমন সময় বাসে একজন ফল বিক্রেতা উঠলো।নীলাঞ্জন তাকে ডেকে দুটো কলা,দুটো আপেল,দুটো নাসপাতি আর দুটো কমলা লেবু নিলো।সেগুলো সে একটা একটা করে খেতে শুরু করলো।মেয়েটার তো নীলাঞ্জনের খাওয়া দেখে ও গা জ্বলে যাচ্ছে।মনে মনে ভাবছে(রাক্ষসের মত খাচ্ছে দেখো..) নীলাঞ্জন খেতে খেতে-
-এই আমায় রাক্ষস ভাবছেন তাই না?
এ বাবা,তার মনের কথা ছেলেটা জানলো কীভাবে-ভাবলো মেয়েটা।
-আপনি খাবেন..?
-দরকার নেই..আপনি যেমন রাক্ষসের মত গিলছেন গিলুন।
-দেখলেন দেখলেন আমি ঠিকই ধরেছি আপনি আমাকে রাক্ষস ভাবছিলেন..
মেয়েটা কোনো উত্তর করলোনা।যত তাকে এড়িয়ে যাওয়া যায় ততই মঙ্গল।ঠিক ওই সময় সামনের একটা সীট থেকে একজন প্যাসেঞ্জার নেমে যেতে সীটটা খালি হয়ে গেলো।মেয়েটা উঠেই পড়েছিলো সেটায় গিয়ে বসতে,আচমকা তার খেয়াল পড়লো যদি ভাড়ার কথা মনে পড়ে যায় কন্ডাকটর এর।ফের বসে পড়লো সে।
-কী হলো,গেলেন না যে...প্রচুর বুদ্ধি না..যদি ভাড়া চেয়ে নেয়।
-আপনি চলে যান না..আপনার তো আমায় নিয়ে সমস্যা।
-নাহ..এখন আর আপনাকে সমস্যা মনে হচ্ছেনা।
-হুম..মজা নিচ্ছেন তো..বুঝিনা আমি..
-এতই যখন বোঝেন তাহলে আপনার চুলগুলো খুলে দিয়ে আছেন কেন..আমার আপেলটা নষ্ট হয়ে গেলো তো..
মেয়েটা- -কী..?
নীলাঞ্জন তার আধখাওয়া আপেলের ওপর মেয়েটার মাথার একটা লম্বা চুল ছিঁড়ে পড়েছে সেইটা মেয়েটার চোখের সামনে তুলে ধরলো।মেয়েটা এবার কী বলে।নীলাঞ্জনকে সরি বলতে তার ইচ্ছেও করেনা।তাও সৌজন্যতার খাতিরে মাথার চুলটা খোঁপা করতে করতে-
-সরি..আপেলের দাম কত বলবেন দিয়ে দেবো..
-বাসভাড়া দিতে পারেনা...আবার বলে কি আপেলের দাম দেবে।
-খুশিগঞ্জে আমারও বাড়ি..দেখা করে দিয়ে দেবো হয়েছে..
-তা নাম কী,খুশিগঞ্জের খুশি বুঝি..?
-আপনার জেনে কাজ নেই...
-এমা..পরিচয় না করলে আপেলের দাম দিতে আসবেন কীকরে..?
-আপনি কী সুন্দরী মেয়ে দেখে ফ্ল্যার্ট করতে শুরু করেছেন?
-বেশ গর্ব দেখছি নিজেকে নিয়ে...
-নইলে কোনো ছেলে তো আর যেচে এত কথা বলতো না..
-তাহলে আমিও তো আমাকে হ্যান্ডসম বলতে পারি..তা না হলে আপনিই বা এত কথার উত্তর দিচ্ছেন কেন?
মেয়েটা যতবার ভাবছে যে কথা এগোবেনা।নীলাঞ্জন ঠিক কিছু না কিছু বলে তাকে বলতে বাধ্য করাচ্ছে।তাই সে ঠিক করলো যে বাকি পনেরো মিনিটের রাস্তাটা সে আর কোনোভাবে ছেলেটাকে কোনো কথার উত্তর দেবে না।সে চুপ করে গেলো একেবারে।কিন্তু, সে চুপ করে যাওয়ার পর এটা লক্ষ্য করলো যে ছেলেটাও চুপ করে গেছে।কী হলো ব্যাপারটা?
পনেরো মিনিট আর দুজনের কোনো কথা নেই।খুশিগঞ্জ এসে পৌছাতে মেয়েটা সীট ছেড়ে ওঠবার আগে নীলঞ্জনকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো-
-আমি নীলিমা চ্যাটার্জি।শুধু আপেলের টাকাটা দেওয়ার হলে বলতাম না।বাসভাড়াটাও দিয়েছেন।নন্দী মিষ্টান্ন ভান্ডারের সামনে কাল বেলা এগারোটার দিকে আসবেন টাকাটা মিটিয়ে দেবো।
নীলাঞ্জন তো অবাক।নীলিমা জানলো কীকরে যে বাসের ভাড়াটা সে মিটিয়ে দিয়েছে?নীলিমা উঠতে গিয়ে তার ওর্ণার একটা কোন নীলাঞ্জনের জামার বোতামে আটকে যাওয়া অবস্থায় থাকায় টান পড়লো।নীলাঞ্জন তা দেখে তার ওর্ণাটা জামার বোতাম থেকে খুলতে খুলতে বললো-
-মন বলছে খুব শিগ্রি আপনার সাথে আবার দেখা হবে..
-,হবে তো..কাল..শেষ দেখা..
নীলাঞ্জন ওর্নাটা ছাড়িয়ে দিয়ে বললো-
-হয়তো কালকের আগেই..আর শেষবার না আমাদের আরও বহুবার দেখা হবে এও মন বলছে।
কী অদ্ভুত..সেদিন সন্ধ্যায় রাকেশের বিয়েতে গিয়ে নীলিমা সত্যিই অবাক হলো নীলাঞ্জনকে দেখে।আর নীলাঞ্জন বুঝলো তার মন তাহলে মিথ্যে বলেনা।সে একগাল হাসি মুখে নীলিমার দিকে এগিয়ে গিয়ে-
-দেখলেন..কী বলেছিলাম,আমাদের খুব শিগ্রি দেখা হবে..
নীলিমার মুড ভালো ছিলো।সেও হাসি মুখে-
-তাইতো দেখছি...জ্যোতিষী নাকি?
-কিছুটা..তা এখানে কীভাবে?
-আমি তো রাকশেদার বোনের বান্ধবী..আপনি?
-রাকেশের ছোটোবেলাকার বন্ধু...
-বেশ..যাই হোক,সকালার ব্যবহারে কিছু মনে করলে সরি আমি..
-আমিও সরি..
খানিকক্ষন দুজনেই নীরব রইলো।কী বলবে না বলবে কিছু বুঝে উঠতে পারলোনা কেউই।হঠাৎ নীলাঞ্জন বলে উঠলো-
-গোলাপ বাহার থেকে ল্যাহেঙ্গাটা কিনেছেন না?
-হ্যাঁ,জানলেন কীকরে?আপনিও যান নাকি ওখানে মিসেস বা গার্লফ্রেন্ডের জন্য কেনাকাটি করতে?
হাসলো নীলাঞ্জন।তারপর হাসি থামিয়ে-
-দুটোর কোনোটাই হয়নি এখনও..এমন ইন্ট্রোভার্ট ছেলেকে কে মন দেবে?
-আপনি ইন্ট্রোভার্ট..!মানে কুচ ভি..
-সত্যি..সারাদিন কাজ নিয়ে থাকি...আর এসব হয়ে ওঠেনি..তবে গোলাপ বাহার ভালো করে চিনি।ডিজাইনগুলো কেমন লাগে আপনার?
-হেব্বি..মানে জাস্ট...দারুন..ডিজাইনারের এলেম আছে।
-তাই না..?
-সে আর বলতে...
নীলাঞ্জন নিজের ডিজাইন করা ল্যাহেঙ্গাটার দিকে তাকিয়ে ভাবলো- সঠিক মানুষটার জন্য সে সঠিক ডিজাইনটাই তো বানিয়েছে।এই ল্যাহেঙ্গাতে একমাত্র নীলিমাকেই মানাতো। নীলিমাকেই।
নীলিমার খেয়াল পড়লো নীলাঞ্জনকে টাকাটা ফেরত দিতে হবে।তা দেখা যখন হয়েই গেছে দিয়েই দিই।সে পার্স থেকে টাকাটা বের করে নীলাঞ্জনকে দিতে চাইলে সে বললো-
-এই হিসেব মেটানোর কথা তো আগামীকাল,নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট স্থানে...এখানে তো নেবো না..
অগত্যা..নীলিমাও আর জোর করলোনা।আর একবার না হয় দেখাই হবে বড়জোর তাদের।তাছাড়া নীলাঞ্জন ততটা খারাপ ছেলে না।যে অন্য মতলব থাকবে।এতটা তো দেখে তার মনেই হয়েছে।
পরদিন যথা স্থানে যথা সময়ে দুজনের দেখা হলো।নীলিমা পার্স থেকে তাকে টাকাটা বের করে দিতে যাওয়ার সময় নীলাঞ্জন নীলিমার হারিয়ে যাওয়া পার্সটা তার দিকে বাড়িয়ে দিতে সে অবাক হয়ে গেলো।
-আপনি..আপনি এটা কোথায় পেলেন?
-আজ্ঞে গোলাপ বাহারি আমাদেরই দোকান।আপনি কাল তো এটা ফেলে এসেছিলেন।আর বাসে আপনার হাতে আমাদের দোকানের প্যাকেটটা দেখে দোকানে জানিয়ে দিয়ে ছিলাম।তবে আমার নিজের হাতের ল্যহাঙ্গাটাই যে আপনি পছন্দ করে নিয়েছেন সেটা জানতাম না।রাকেশের বিয়েতে গিয়ে বুঝলাম।
কী বলছে নীলাঞ্জন?সে গোলাপ বাহারির ডিজাইনার কাম মালিক!সে তো খুশিতে গদগদ হয়ে-
-জানাননি কেন আগে..?
-জানিয়ে দিলে এই যে আমাদের মধ্যে ঘটে যাওয়া একটা পুরো দিনের এমন একটা স্মৃতি কী আমরা বানাতে পারতাম তাই না?তবে আপনাকে প্রচুর বিরক্ত করেছি বলুন।আমিনা সত্যি লজ্জিত।
-লজ্জিত তো আমার হওয়া দরকার..আসলে কাল মুডটাও একটু বিগড়ে ছিলো..
-সেটা বুঝেছি..নইলে আপনাকে দেখে মনে হয়না আপনি এত মেজাজী একটা মেয়ে।যাই হোক,আমার মত ইন্ট্রোভার্ট মার্কা ছেলেটার মুখেও আপনি কথা ফুটিয়েছেন আর এটা বুঝতেও দেননি যে কীভাবে আপনার সাথে সময়টা কেটে গেছে।আপনার কোম্পানি পেয়ে সত্যি আমি মুগ্ধ।ধন্যবাদ।
নীলিমার আর কী বলার থাকতে পারে।সে নিরুত্তর রইলো।
অবশেষে নীলাঞ্জন নমস্কার সেরে-
-বেশ আসি তাহলে...ভালো থাকবেন...আর হাসবেন।হাসিটা না স্যুট করে আপনার সাথে।
-আপনিও ভালো থাকবেন।
নীলাঞ্জনের নীলিমাকে কোথাও ভালো লেগে গিয়েছিলো। কিন্তু সে তার মনের কথা মনেই রেখে দিলো।নীলিমার সাথে কাটানো একটা দিন তার আজীবন মনে থাকবে।নীলিমারও নীলাঞ্জনের প্রতি ধারনা বদলাতে শুরু করেছিলো আগেই তবে নীলাঞ্জনের মনের মত সে ততটাও এগোতে পারেনি।
মাঝে দুটো দিন কেটে গেলো।নীলাঞ্জন এর বহুবার নীলিমার কথা মনের মধ্যে জেগেছে।ওদিকে নীলিমার যে একেবার এ নীলাঞ্জনকে মনে পড়েনি তা নয়।
পরদিন নীলাঞ্জন যেদিন ব্যাঙ্গালোর ফিরে যাওয়ার জন্য বাসে উঠবে।ও মা দেখে স্ট্যান্ডে নীলিমা দাঁড়িয়ে।আর সে নিজেকে আটকে রাখতে পারলোনা।সে এগিয়ে গেলো হাসি মুখে নীলিমার দিকে।নীলিমারও নীলাঞ্জনকে চোখে পড়ায় সে ও তার দিকে এগিয়ে এসে-
-কী ব্যাপার কোথায় যাচ্ছেন?
-এই তো ব্যাঙ্গালোর ফিরছি আর কি..আপনি?
-আপনাদেরই দোকান...
-তাই বুঝি কেন?
-একটা কুর্তি নেওয়ার আছে..
-তাহলে নতুন একটা কুর্তি দোকানে এসেছে..আমি ফোনে বলে দিচ্ছি..ডিসকাউন্টও পেয়ে যাবেন।আশা করি ভালো লাগবে।
বাসে উঠলো দুজনে।পাশাপাশিই বসলো।কথাবার্তা চলতে চলতে গোলাপ বাহারির সামনে বাস এসে থামতে নীলিমা নামতে গিয়ে হঠাৎ পিছু ফিরে বললো-
-আপনিও চলুন না যদি দেরী না হয়ে থাকে..আপনার ডিজাইন করা যেটা বেস্ট সেটা নিতাম..
নীলাঞ্জনের ট্রেন ছিলো।তাও সে নীলিমার এক কথায় নেমে পড়লো।তারপর দোকানের ভেতরে প্রবেশ করতে নীলাঞ্জন কে দেখে তার বাবা তো খুশিতে একাকার।আসলে নীলাঞ্জন এর সাথে ওর বাবার সম্পর্কটা ভালো না।দুজনেই দুজনকে বড্ড ভালোবাসে তাও কেউ কাউকে তা বুঝতে দেয় না।তাই ছেলেকে দোকানে দেখে বাবা খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করলো-
-তুই যাবিনা ব্যাঙ্গালোর?
তখন পাশ থেকে নীলিমা উত্তর দিলো-
-উনি আমাকে একটা কুর্তি পছন্দ করে দিতে এসেছেন যেটা ওনার হাতের ডিজাইন করা।
নীলাঞ্জনের বাবা তো অবাক মেয়েটার কথা শুনে।তাঁর ছেলে আবার কবে থেকে অন্য কারোর কথা রাখতে শুরু করেছে।বাবা বুঝলো ছেলে বুঝি এই মেয়েকে...যতই হোক বাবা তো।ছেলের মন আর বুঝবেনা।নীলাঞ্জন দোকানের কারিগরের সাথে ভেতরে গেলে পর তার বাবা নীলিমাকে কাছে ডেকে বললো-
-একটা উপকার করবে মা?
-হ্যাঁ বলুন না...
-আমার ছেলেটাকে আর ব্যাঙ্গালোর যেতে দিওনা।
-আমি?এমা আমার কথা উনি শুনবেন কেন?
-তুমিই পারবে...আমার ছেলেটা যে বড় একলা..
আর সত্যিই তাই হলো।নীলাঞ্জন তার হাতের ডিজাইন করা একটা কুর্তির সেট নিয়ে এসে নীলিমার সামনে রেখে বলল-
-আপনার কোনটা পছন্দ হয় দেখুন..
নীলিমার বাবা ভেতরে চলে গেলো।তারপর উনি চলে যেতে নীলিমা কুর্তিগুলো দেখতে দেখতে বলল-
-আমার তো সবকটাই মনে ধরেনে।আপনিই না হয় একটা পছন্দ করে দিন..
নীলাঞ্জন তার জন্য একটা কুর্তি পছন্দ করে তার হাতে দিয়ে বলল-
-এটা আপনাকে বেশ মানাবে..
তখন নীলিমা তাকে একটা প্রশ্ন করলো-
-আমার একটা কথা রাখবেন?
-কি বলুন?
-আপনার বাবার ইচ্ছে আপনি এখানেই থেকে যান..
-বাবা বলেছে একথা আপনাকে?
-হ্যাঁ,ওনার মনের প্রতিটা অভিব্যক্তিজুড়ে শুধু এই কথাই লুকিয়ে ছিলো...
-আর আপনার মনের অভিব্যক্তি..সেটা তো জানা হলো না।
নীলিমা একটু লজ্জা পেলো।তারপর সে বললো-
-সেটা আপনিই বুঝে নিন..আপনি তো জ্যোতিষী..
হাসলো দুজন।ভেতর থেকে নীলাঞ্জনের বাবা তাদের কথাগুলো শুনছিলো।ছেলে আর বাইরে যাবেনা জানতে পেরে তার দু চোখ বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়লো।ছেলেকে তিনি কাছে পাননি বহুদিন।নীলিমা যে তাঁর ছেলেকে মায়ায় বেঁধেছে।
নীলাঞ্জনের আর সেদিনের ব্যাঙ্গালোর এর ট্রেন ধরা হলোনা।নীলিমা নামের এক মায়া শক্তি তাকে খুশিগঞ্জে আটকে দিলো।সারাজীবনের জন্য।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন