Breaking

বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ১২

সুখী পরিবার


 'শোনোনা,ঋকের ফিজটার জন্য ওদের স্কুল থেকে আজ ফোন এসেছিলো।'-রিমি কথাটা দিব্যকে বলতে দিব্য বলল-'কাল গিয়ে আসবে।আমি দিয়ে দেবো।'এরপর দিব্য আর কোনো কথা বললো না।পাশ ফিরে চোখ বোজালো।রিমিও দিব্যকে আর বিরক্ত করলো না।সে জানে যে দিব্যর ব্যবসা ইদানীং তেমন ভালো চলছে না।কিন্তু,যে গুলো দিব্যর কাছে না চাইলেই নয়-সেগুলো আর না চেয়ে রিমি থাকে কীকরে?দুজনেই চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর অভিনয় করছে,কিন্তু ঘুম কারোর চোখেই নেই।চিন্তা,আগামী দিন গুলো কীভাবে সংসারটা চলবে।


পরদিন দোকানে যাওয়ার আগে দিব্য মানিব্যাগটা খুলে দেখলো আর চারটে পাঁচশো টাকার নোট ও সামান্য কিছু খুচরো অবশিষ্ট রয়েছে।তার থেকেই পাঁচশোটাকা স্কুলের ফিজ,আর একটা পাঁচশো টাকা সে রিমির হাতে দিয়ে বললো-'বাবুর স্কুলের ফিজটা দিও আর তোমার বাকি ওষুধ গুলো সুপ্রিয়র দোকান থেকে নিয়ে নিও।' তারপর সে মুড়ির টিফিনটা নিয়ে দোকানের উদ্দ্যেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।

শেষ ক'মাসে ব্যবসায় মন্দা চলায় দিব্যর চোখ মুখের অবস্থা চোখে দেখা যায়না।রিমি মনে মনে ভাবলো-আমরা মেয়েরা ঘরের কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠি,তাহলে একজন পুরুষের মাথায় কত চিন্তা হয়?একটা পুরো ফ্যামিলির ভরনপোষণের দায়িত্ব....।রিমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্না ঘরের দিকে চলে গেলো।ঋকের স্কুল ফিজতো সে ভরলো কিন্তু, নিজের ওষুধ গুলো আর কিনলোনা এই ভেবে যে, পাঁচশো টাকাটা অন্য দরকারের সময় কাজে আসবে।

দিব্য সারাদিন দোকানে বসে।এক আধটা খদ্দের এসেছিলো তাও মাত্র কয়েকটাকার জিনিসপত্র সে ক্রয় করেছে।বেলায় টিফিনও করেনি।খাওয়া দাওয়া সব সিঁকেয় উঠেছে।মাথায় শুধু চিন্তা।কবে সব কিছু আগের মত ঠিক হবে তারও কোনো আশা দেখতে পাচ্ছে না চোখে।দুপুরে বাড়ি ফেরার আগে একবার সে ব্যাঙ্কে গেলো।দুটো এফ.ডির একটা এবার তাকে ভাঙতেই হবে।সেইজন্য দরখাস্ত লিখলো।বাড়ি ফিরে চাবি আর কাগজপত্রের ব্যাগটা বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে মাথার ওপর পাখাটা সাঁই সাঁই করে চালিয়ে দিলো।

রিমি খাবার জন্য হাঁক দিলো।কোনো সারা পেলো না দিব্যর।বাধ্য হয়ে ঘরের মধ্যে এসে দেখে দিব্য জামার বোতামগুলো খুলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে চিন্তায় ডুবে আছে।রিমি তার সামনে দাঁড়িয়ে কপালের চুলে হাত বুলিয়ে বলল-'সব ঠিক হয়ে যাবে।'দিব্য রিমির বুকে আশ্রয় নেওয়ার মত করে মাথা রেখে তাকে জড়িয়ে ধরলো।রিমি তার মাথাটা দুহাতের পরম আদর দিয়ে জড়িয়ে বলল-'ইশ্বর আছেন দিব্য।'দিব্য বলল-'তিনি কবে মুখ তুলবেন?এ মাসে আমাদের বিবাহবার্ষিকী তে আমরা বেড়াতে যাবো ভাবলাম।তার জায়গায় তোমাদের ঠিকমত খেতে পরতেই দিতে পারছিনা।' রিমি তখন একটু আদুরে সুরে বলল-'বিবাহবার্ষিকী আর কী আমরা পাবো না?পরের বছর যাবো নয়। চলো,বেলা হয়েছে,এবার খেয়ে নিই।আজ তোমার জন্য তোমার পছন্দের পাঁপড়ের ঝাল রান্না করেছি।'

বিকেলে দোকান বেরোনোর আগে কারেন্টের বিল এসেছে দেখলো।সাতশো টাকা।দিব্য ভাবলো,দুদিন পর এফ.ডি ভেঙে টাকাটা পেলে তার থেকেই বিলটা মেটাবে।দোকানে গিয়ে সেই একই অবস্থা।খরিদদার নেই।আবার তার চিন্তা শুরু হলো।মাস খানেক বা টেনে টুনে মাস দুয়েক এফ.ডির টাকাটায় চলে যাবে, পরে কী হবে,যদি ব্যবসায় এমন ভাবেই মন্দা চলতে থাকে?সংসারের নিত্য খরচ, ওষুধপত্র, ছেলের স্কুলের ফিজ,আঁকার ফিজ,ইলেকট্রিক বিল..।বন্ধুদের থেকেও ধার চাইতে তার সম্মানে বাধে।তাছাড়া সবার অবস্থাই তারই মত বা একটু ভালো।ধার চাইলেই কী কেউ সাহায্য করতে পারবে? বরং উল্টে বন্ধুকে নানা সংকোচের মধ্যে ফেলা হবে।অতএব,ধার চাওয়া বাদ।

দিন সাতেক পর একদিন রাতে রিমি তার মাসতুতো বোনের বিয়ে, নিমন্ত্রন করে গেছে।দিব্য ভাবলো,এই অসময়ে আবার বিয়েবাড়ি কেনো?নিমন্ত্রন রাখতে যাওয়া মানেই তো খরচ।কিন্তু,আবার এও ভাবলো যদি নাও যায় তাহলে রিমির সম্মানটা কোথায় নামে।সে রিমিকে কেনা কাটির বিষয়ে কিছু বলতে যাবে,ঘুরে রিমি তাকে বললো-'শোনোনা,আমার না নতুন একটা তাঁতের শাড়ি আছে।ভাঙিনি এখনো।ওটাই বোনকে বিয়েতে দিয়ে দিলে কেমন হয়?'দিব্য বলল-'পাগলি নাকি?তুমি তোমার স্বামীকে এতটাই সামর্থ্যহীন ভাবো নাকি যে..।'রিমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল-'এমন কথা বলছো কেনো?আমি কখনো বলেছি যে তুমি আমায় খারাপ রেখেছো?শুধু এখনের পরিস্থিতি ভেবে বললাম।'দিব্য বলল- 'না।তোমাকে এত ভাবতে হবে না।আমি টাকা দিয়ে দেবো,তুমি পছন্দ মত শাড়ি কিনে আনবে।'রিমি তখন দিব্যকে আর কিছু না বলে তার কোলে মাথা রাখলো।দিব্য তার কপালে হাত বোলাতে বোলাতে বললো-'দেখবে একদিন অভাব মিটে যাবে আমাদের।তখন তোমাকে রাণীর মতন রাখবো।' রিমি বললো-'জানিতো।তুমি যে আমার মহারাজা।'

দিন চারেক পর একদিন সন্ধ্যেয় দিব্যর মাথার ঠিক নেই।পাশের দোকানদারের সঙ্গে মন কষাকষি হতে সে দোকান বন্ধ করে ব্রিজের ওপর ফুটপাতে এসে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলো।ইচ্ছে ছিলো ড্রিঙ্ক করার।সামর্থ্য কুলোলোনা।ব্রিজের ওপরের ঠান্ডা হাওয়ায় সবে তার মাথাটা ঠান্ডা হতে শুরু করেছে, এমন সময় তার লক্ষ্য পড়লো একজন অন্ধ ভিখিরি বসে বসে আপন মনে চেনা একটা বাউল গাইছে।তার গান যেন অজান্তেই দিব্যকে তার দিকে টেনে নিয়ে গেলো।দিব্য দেখলো,ভিখিরির থালায় মাত্র ক'টা দু এক টাকার কয়েন পড়ে মাত্র।ভিখিরি টা এও জানেনা,আদেও তার খাবারের জন্য অর্থ টুকুও জোগার হয়েছে কিনা!সে কেবল গান গেয়ে চলেছে।তার চিন্তাভাবনা নেই?সে তাহলে কীকরে বাঁচিয়ে রেখেছে নিজেকে?এসব নানান প্রশ্নে দিব্য একটা জিনিস উপলব্ধি করতে পেরেছিলো-চড়াই উৎড়াই নিয়েই জীবন।


চিন্তাভাবনা কে বেশি মদত দিলে সে মাথায় চড়ে বসবে।তখন সে ভিখিরির সাথে গলা মেলালো।অনেকদিন পর তার অন্তরটা কেমন যেন অজানা এক ভালোলাগায় মিশে গিয়ে বোঝামুক্ত হলো।সে ফিরে যাওয়ার আগে ওই ভিখিরির থালায় একশো টাকা দিয়ে গিয়েছিলো তার কাছ থেকে জীবনের এই অসময়ে মূল্যবান শিক্ষাটা পাওয়ার জন্য।যদিও এ শিক্ষার কোনো মূল্য দেওয়া চোকানো যায়না।শুধু এই শিক্ষারই কেনো,কোনো শিক্ষারই দাম দেওয়া যায়না।তবু, কথায় বলে,সুখের সময়ে অন্যকে সাহায্য করতে হয়।সে সেই মুহুর্তে ভীষন সুখি মনে করেছিলো নিজেকে।




জীবনের প্রতিটা মোড়ে নতুন কিছু না কিছু অপেক্ষা করে থাকে।সেটা পেতে অপেক্ষা করতে হয়।সেদিন বাড়ি ফেরবার সময় সে রিমির জন্য ওষুধ কিনে নিয়ে গেলো।কারন সে জানতো রিমি ওষুধ কেনেনি।ছেলে মাংস খেতে ভালোবাসে তাই মাংস কিনলো।বাড়ি ফিরতেই রিমি দিব্যর কান্ড দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো- 'দোকানে কী ভালো বেচা কেনা হয়েছে নাকি?' দিব্য হাসি মুখে বলল- 'ধরে নাও তাই।'রিমিও স্বামীর মুখে খুশির ঝলক দেখে স্বামীর হাতটা চেপে ধরলো।দিব্য জানে যে সে মিথ্যে বলেছে,কিন্তু সেই মিথ্যের মধ্যেই তার আত্ম বিশ্বাস লুকিয়ে ছিলো।আর এই আত্মবিশ্বাস তাকে আগামী দিনে বিরাট একজন ব্যবসাদার বানিয়ে তুলেছিলো।


ভালোবাসার মানুষ পাশে থাকলে আর নিজের প্রতি বিশ্বাসটা থাকলে দুঃসময়কেও চ্যালেঞ্জ করা যায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন