পুজোর আর মাত্র কটা দিন বাকি। অন্তুর হাত একেবারে যে ফাঁকা।আগের মাসে মায়ের হার্ট অপারেশনের জন্য ব্যাংক এর এফ ডি টাও তাকে ভাঙতে হয়েছিলো।ওদের খোকার জন্য খুব কষ্ট করে জমিয়েছিলো টাকাকটা। এদিকে এ মাস এর মাইনের দশ হাজারটাও সংসার খরচে প্রায় শেষের দিকে।মাস শেষ হতে এখনও প্রায় দিন দশেক বাকি।তার মাঝে আবার পুজো।কী ভাবে সংসার চালাবে তাই সে ভেবে পাচ্ছে না তার ওপর আবার পুজোর কেনাকাটি।এমনিতেই তো সারা বছর ছেলে বউ আর মাকে খাওয়া পরা টুকুনির বাইরে সেভাবে কিছুই দিতে পারে না।আর এই একবার মাত্র পুজোয় একটু নতুন জামাকাপড় কিনে দেবে,সেটাও যদি সে না পাড়ে!
সেদিন অফিস থেকে ফিরে রাতে মেঝেয় পাতা আসনের ওপর বসে অন্তু নিজের চিন্তায় ডুবে ছিলো।কথায় বলে যে খেতে বসে চিন্তা করতে নেই।অন্তুর চিন্তায় ডুবে যাওয়া মুখ খানি দেখে তিন্নি তার সামনে খাবারটা ধরে দিলে পর তখন ও অন্তু যখন অন্যমনস্ক ভাবেই বসে রইলো তখন তিন্নি খুব নরম গলার ভাবেই তাকে জিজ্ঞেস করলো-
-কী হয়েছে গো,কী চিন্তা করছো?
অন্তুর চোখের পলক থেকে অন্যমনস্কতার রেখা তিন্নির কন্ঠে সরে যাওয়া মাত্রই সে বলে উঠলো-
বলে খাবারের থালাটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে সে তিন্নির দিকে তাকিয়ে বললো-
-তোমার খাবারটা নিয়ে এসো।একসাথে খেয়ে নিতাম তো।
তিন্নি এমনিতে সবাইকে খাইয়ে নিজে সবার শেষেই খায়।কিন্তু অন্তুর বলায় সে উঠে গিয়ে রান্নাঘর থেকে তার নিজের খাবারটা নিয়ে এসে দেখে অন্তু রুটির মধ্যে ঘুগনিটা নিয়ে সেই আগের মতই অন্যমনস্ক ভাবে কী যেন ভাবছে।অন্তুর ঘুগনি ভীষন প্রিয় রুটির সাথে।তার ওপর সেটা যদি তিন্নির হাতের রান্না হয় তো সে খুব আয়েশ করে খায়।কিন্তু সেদিন অন্তুর মধ্যে সেই আগের ব্যাপারটা নেই দেখে তিন্নি আবার জিজ্ঞেস করলো-
-আরে না না..এই তো খুব ভালো হয়েছে।
বলে রুটির টুকরোটা মুখের মধ্যে নিয়ে ফের নি:শব্দে মুখ নাড়তে লাগলো।তিন্নিও তার নিজের খাবারটা নিয়ে তার পাশে বসে পড়লো।আর নিজের হাতে রান্না করা ঘুগনির স্বাদ নিয়ে বুঝলো যে ঘুগনিটা যথেষ্ট ভালো রান্না হয়েছে।তাহলে অন্তু একবারও তার প্রশংসা করলো না কেন।অন্তু তো তিন্নির হাতের রান্নার প্রশংসা করতে ভোলে না।নিশ্চই কিছু হয়েছে।সে তাই জানতে চাইলো-
-ওই আর কি,সামনেই পুজো,বুঝতেই তো পারছো..
তিন্নি বুঝলো অন্তু তার মনের ভেতরে গোপন করা সত্যিটা তাকে বলছেনা।খাওয়া দাওয়ার শেষে তিন্নি যখন নিজের কাজ কম্ম গুছিয়ে শোবার ঘরে এলো তখন দেখে ঘরের লাইট বন্ধ করে দিয়ে নি:শব্দে অন্তু বিছানায় শুয়ে আছে।ফোনটাও দেখছে না।তিন্নি অন্তুকে ভালো করে চেনে।সে নিজের কষ্ট সহজে কাউকে বলে না।নিজের মনের চেপে রেখে দেয়।আর সরাসরি জানতে চাইলেও বলবেনা।
তাই সে ভেজা চোখ হাতটা মুছে হঠাৎ করতে ইচ্ছে করে -'আহ' শব্দটা করা মাত্রই অন্তু তিন্নির গলায় অস্ফুট যন্ত্রনার শব্দ টা শুনতে পেয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে -
বলে ঘরের বন্ধ আলোটা জ্বালিয়ে দিয়ে তিন্নির কাছে প্রায় ছুটে গেলো।তিন্নিকে সে ভীষন ভালোবাসে।নিজের অফিস এর কাজ বাদে যতটুকু সে ঘরে থাকে ততটুকু সময় তিন্নি কে তিন্নির কাজে যথাসাধ্য সাহায্য করে।ওর খেয়াল রাখে।
তিন্নি মিছিমিছি করে অন্তুকে জানায়-
-তুমি তো কলে গেলে না আজ।অন্ধকারে বাসন ধুতে গিয়ে হাতটা কেটে গেছে।
বলে সে তিন্নির হাতটা স্পর্শ করেছে কি তিন্নি তার হাতটা চেপে ধরে নিজের মাথায় নিয়ে বললো-
-আমার দিব্যি,বলো তোমার কী হয়েছে?,
তিন্নির মাথায় হাত রেখে অন্তু মিথ্যে বলতে পারবে না।সে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে তিন্নিকে জানালো-
-আমার মন ভালো নেই তিন্নি।
শুধু এই কথাটুকু অন্তু তাকে বলেছে,সে বুঝে গেলো যে তার মন কেন ভালো নেই।সেই মত সে উত্তরও করলো অন্তুকে-
-একটা বছর নতুন জামাকাপড় না হলে কী পুজো কাটানো যায়না।আমার অনেকগুলো নতুন শাড়ি আছে।কতগুলো তো এখনও ভাঙাই হয়নি।সেগুলো কবে পরবো।আর রয়ে গেলো বাবাই এর কথা।ওর দাদাই তো পাঠাবে ওর জন্য। শুধু মাকে একটা কিনে দিও।
বলে সে অন্তুর হাত থেকে নিজের হাতটা সরিয়ে নিয়ে আলমারিটা খুলে ছয়শোটাকা বের করে অন্তুর হাতে দিয়ে বললো-
-এটায় মায়ের একটা শাড়ি নেবে কাল।তিনশোর মধ্যে আশা করে হয়ে যাবে।আর বাকিটা দিয়ে তোমার নিজের জন্য মোটামুটি দেখে একটা জামা নেবে।আগের বছরও তুমি নিজের জন্য কিছু নাওনি।
অন্তু হাতে টাকাটা ধরে তিন্নির চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো-
-এটা কোথা থেকে এলো।আমি তো এমাসে তোমাকে সংসার খরচের জন্যও অল্প টাকা দিয়েছিলাম।তাহলে?
-আমি তার মধ্যে থেকেই একটু একটু করে বাঁচিয়ে রেখেছি।
-না না..এটা তুমি রাখো।আমার বোনাসের টাকাটা এলেই আমি সবার জন্য..
-সে কখন আসে না আসে..তার ওপর সেই টাকা থেকেও তো তোমার খরচ আছে।এটা এখন রাখো।
অন্তু নিতে চাইলো না কিন্তু তিন্নি ফেরত নেবে না।অবশেষে অন্তু তার মায়ের শাড়ির জন্য তিনশো নিয়ে তিনশো ফেরাতে চাইলে পর তিন্নি তাকে বললো-
-নিজে তো তোমায় কিছু দিতে পারিনা।আজীবন আমাদের সুখের জন্যই করে এলে।তোমার টাকাতেই তোমাকে দিচ্ছি। তাই এটা আমি নেবোনা।
অন্তুর টাকাটা নিয়ে দু চোখে জল গড়িয়ে পড়লো।সে তিন্নি কে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললো-
-আমি তোমাকে একটা ভালো জীবন দিতে পারলাম না তিন্নি।সারাটা জীবন অভাবের মধ্যে তোমাকে মানিয়ে নিতে হচ্ছে।
তিন্নি অন্তুকে শান্ত করতে করতে মাথার এলোমেলো চুল গুলোয় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো-
-কে বলেছে আমি তোমার সাথে মানিয়ে নিয়ে আছি।তুমি যে ভালোবাসাটা আমায় দাও সেই ভালোবাসা কী আর অন্য কোথাও গেলে পেতাম আমি বলো।তোমার মত কেউ আমায় ভালোবাসতে পারবেনা অন্তু।
পরদিন অফিসে যাওয়ার আগে অন্তুকে তিন্নি ফের মনে করিয়ে দিলো যে -
-আজকে কিন্তু মনে করে নিয়ে আসবে তোমার আর মায়ের জামাকাপড় মনে করে।
অন্তু ঘাড় তো নাড়লো কিন্তু তবু তার মনের ভেতর থেকে বিষন্নতাটুকু সরে গেলোনা।অফিসে যাওয়ার পথে একটা দুর্গা মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে অন্তু মাকে প্রণাম করে প্রার্থনা করলো-
-একটা কিছু ব্যবস্থা করে দাও মা।যেন আমাদের পুজোটাও ভালো যায় আর পাঁচ জনের মত।
মা কোনোদিনও তার সন্তানকে নিরাশ করেন না।আচমকা সেদিনই কাজের শেষে অন্তুর হাতে পাঁচ হাজার বোনাসের টাকা উঠলো।সেই টাকাটা হাতে পেয়ে তার মত সুখী হয়তো পৃথিবীতে সেই মুহুর্তে আর কেউ ছিলোনা।মধ্যবিত্তের সামান্য পুঁজি।স্বপ্নও সামান্য।সেই স্বপ্নটুকুও সে যখন পূরণ করতে পারে তখন তার মত সুখী মানুষ আর কে ই বা হয়!
অন্তু সেদিন ঘরে ফেরার আগে তার নিজের মানুষগুলোর জন্য নতুন জামাকাপড় নিয়ে গেলো।আর যাওয়ার পূর্বে সে আর একবার মায়ের মন্দিরে এসে জোর হাত করে মাকে জানালো-
-আমার মন:স্কামনা পূরন করেছো তুমি মা।এই টা তোমার জন্য তোমার ছেলের এই সামান্য উপহার।
বলে মায়ের মন্দিরে,মায়ের পায়ের নীচে একটা শাড়ি সে রেখে দিয়ে গেলো।ঘরে ফিরে সে যখন তার নিজের মায়ের হাতে নিজের স্ত্রী ও সন্তানের হাতে নতুন জামাকাপড় গুলো দিলো তখন তাদের খুশি দেখে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়লো তার দু চোখ বেয়ে।
তিন্নি অন্তুর কাছে জানতে চাইলো-
-এত সব কেনাকাটির টাকা তুমি কোথায় পেলে?
বলেই তিন্নির দেওয়াটা টাকাটা তার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললো-
-তোমার কষ্ট করে জমানো টাকা তোমায় ফিরিয়ে দিলাম।
-আমার তো টাকা চাইনা। আমি শুধু এই মানুষটার মুখে আজীবন হাসি দেখতে চাই। তোমার এই হাসিটাই আমার জীবনের সবথেকে বড় প্রাপ্তি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন