নেহা নাইট ল্যাম্পটা বন্ধ করে তথাগতর পাশে এসে শুয়ে পড়লো।তথাগত এতক্ষন ফোনে ব্যস্ত ছিলো।সে এবার ফোনটা সুইচড অফ করে বালিশের পাশটায় রেখে দিয়ে নেহার দিকে পাশ ফিরে ওর কপালের এলোমেলো চুলগুলোয় আঙুলের আদর দিয়ে আঁকিবুকি কাটতে কাটতে বললো-
'কালকে গেলে কবে ফিরবে ও বাড়ি থেকে?'.
.-'মায়ের তো পায়ের ব্যথাটা আবার শুনছি বেড়েছে,কয়েক দিন থাকলে তো মায়ের সুবিধেই হয়..'.
. -'তাহলে তোমার স্কুল.. লিভ নেবে নাকি?'.
.-'না না,লিভ নেবোনা।সামনেই ইউনিট টেস্ট আছে.. এখন তো ছুটি চাওয়া যাবেনা..'
-'তবু যত তাড়াতাড়ি পারবে চলে আসবে?..'.
.-'কেন?'
..-'চলে আসবে..'.
.-'আরে সেটাই তো জিজ্ঞেস করছি কেন?'.
.-'জানিনা যাও..' .
.-'মন খারাপ করবে আমার জন্য..?'.
.-'হুম..'.
.-'তাহলে কী যাবোনা আমি..?'..
.-'না যাও..তবে একটু তাড়াতাড়ি চলে আসবে প্লিজ..'.
.-'পাগল...'
কথাটা বলবার সাথে সাথে নেহা দু হাত দিয়ে তথাগতর দুগালে আদর করে কপালে একটা চুমু খেলো।তারপর বললো-'যত তাড়াতাড়ি পারি আমি চলে আসবো কেমন..'
পরদিন তথাগত নেহাকে ওর বাবার বাড়িতে দিয়ে বিকালে বাড়ি ফিরে এলো।
রাতে খাবারের টেবিলে বসে তথাগতর মা ওকে বললো- 'কীরে আজ মাত্র দুটো রুটি খেলি যে..শ্বশুর বাড়িতে ও বেলা খুব ভালো মন্দ খেয়েছিস বুঝি..?'
তথাগত জানলো -'এই একটু আগে বাইরে টিফিন করেছি,তাই আর খাবার যাচ্ছে না।'
খেয়ে উঠে ঘরে ফিরে লাইট বন্ধ করে ও একটা সিগারেট জ্বালালো। আর জ্বালানো মাত্রই সদ্য জ্বলন্ত সিগারেটটা জানালা দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ও বাইরে ফেলে দিলো। আসলে হঠাৎ ওর যেন মনে হলো নেহা বলছে -(কতবার বলেছি সিগারেট খাওয়াটা ছাড়ো)..
পর মুহুর্তেই খেয়াল হলো নেহা তো ঘরেই নেই। ওদের বিবাহের এই দু মাসে নেহা ওর অনেক অভ্যেস বদলে দিয়েছে। নেহা তাই ঘরে না থাকলেও তার অন্তরে যেন সে সব সময়ই বিরাজমান। বিছানায় শুয়ে পাশের ফাঁকা বালিসটার দিকে তাকিয়ে তথাগতর আগের রাত্রিটা মনে পড়ে গেলো। তাই সন্ধ্যেয় ফোন করার সত্ত্বেও সে আবার নেহাকে কল করলো।
নেহা কল রিসিভ না করে মেসেজ পাঠালো -'কী গো,কিছু বলবে নাকি?'.
.-'কী করছো?'.
.-'এইটা জানতে ফোন করছিলে আবার?'.
..-'একবার ভিডিও কল করছি..'
-' মায়ের কাছে শুয়েছি আজ।মায়ের বিরক্ত হবে।কালকে নয় করো।'..
.-'তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে..'.
..-'পাগল একটা..এই তো সন্ধ্যে বেলা দেখলে...'..
.-'কবে বাড়ি আসবে?'...
-'আজই তো এলাম...ভুলে গেলে নাকি এক্ষুনি?..'
-'ঘরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তোমাকে ছাড়া..'
-'সে কি কেন?..'..
-'তোমার কথায় ঘরটা যেন আলো হয়ে থাকে..এখন যেন নিঃশ্চুপ..'..
-'আমি নয় এই দু মাস ও ঘরে গেছি। তাহলে তার আগে..?'...
-'তখন ওটাই অভ্যেস ছিলো.. তারপর থেকে তুমি অভ্যেসে পরিণত হয়েছো আমার..'..
-'আচ্ছা বেশ..মনে করো তোমার পাশেই আমি আছি এখন..তোমার কপালে আদর করে দিচ্ছি.. এবার ঘুমিয়ে পড়ো.. কাল তো অফিস আছে..'..
-'ঠিক আছে আমি ঘুমানোর চেষ্টা করছি।তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো।আর কাল ভিডিও কল করবো কেমন..'..
-'আচ্ছা..শুভ রাত্রি..এক পৃথিবী চুমু পাঠালাম।তোমার স্বপ্ন শুভ হোক...'
পরদিন নেহা অপেক্ষা করেছিলো তথাগতর ভিডিও কলের জন্য। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো তবু ওর কল এলো না।
তাই নেহা তথাগতকে মেসেজ করলো--'ভিডিও কল করবে বললে যে...ব্যস্ত নাকি?'
তথাগতর দিক দিয়ে কোনো রিপ্লাই এলোনা। হঠাৎই মাঝ বিকেলে কোনো খবর দেওয়া নেই তথাগত হাজির শ্বশুরবাড়িতে। শ্বাশুড়ি তো দেখেই অবাক।আগের দিনই তাদের মেয়েকে রেখে গেছে। আজকে কী আবার আনতে চলে এলো নাকি? শ্বাশুড়িমাকে সামনে দেখে তথাগত ওনাকে প্রণাম করলো।
নেহা ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে- 'তুমি? কই আসবে এ কথা তো বলোনি..'..
-'আসলে অফিসে বড্ড চাপ ছিলো.. তোমার হাত ঘড়িটা তো তুমি ঘরেতেই ফেলে এসেছিলে.. তাই দিতে চলে এলাম। তুমি তো ওটাই পরে স্কুলে যাও..' বলে ব্যাগ থেকে হাতঘড়িটা চট করে বের করে সেটা নেহার হাতে দিয়ে বললো-
-'আসছি তাহলে..'..
-'আসছি তাহলে মানে?'- বললো নেহা।
শ্বাশুড়িমা বললো- 'ঘরে উঠে চলো। এরপর কেউ আবার বাড়ি যায় নাকি..সন্ধ্যে নেমে গেছে...'-
' না না, থাকলে চলবেনা..কাজ আছে..।'
নেহা চোখের ইশারায় তথাগতকে ঘরের ভেতরে আসতে বলে মুখে বললো-'না থাকো,কিছু খেয়ে যাবে এসো..'
তথাগত ঘরে উঠে গেলো।শ্বাশুড়িমা রান্না ঘরের দিকে চলে গেলো।
ঘরে ঢুকেই নেহা তথাগতকে বললো-'কী ব্যাপার বলোতো.. আমার কী আর ঘড়ি নেই নাকি..সত্যি করে বলো..'..
-'আসলে তোমাকে কাল থেকেই বললাম না খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিলো।'...
-' তা বলে এতখানি রাস্তা এই অবেলায়... আবার ফিরে যাব বলছো..'
এবার তথাগত কিছু না বলে এদিক ওদিক একবার তাকিয়ে নেহাকে সোজা বুকেতে জড়িয়ে নিলো। নেহা তথাগতর ভালোবাসা পেয়ে নিজেও শক্ত করে ওকে চেপে ধরলো।
তারপর ভীষন নরম সুরে বললো-'এত ভালোবাসা পেতে খুব ভয় হয় জানো।
যদি একদিন সব নিঃশেষ হয়ে যায়..' ..
-'কিচ্ছু হবেনা,আজও তোমায় যতটা ভালোবাসি,কালও তোমায় ততটাই ভালোবাসবো..।'..
'-আর তার পরের দিন তার পরের দিন..?'...
'-প্রতিদিন এ ভালোবাসা বাড়বে বই কমবে না এতটুকুও..'..
-'জানো,আমি স্বপ্ন দেখতাম যে মানুষটা ভবিষ্যতে আমার জীবনে আসবে সে যদি নাও আমার সব ইচ্ছেপূরণ করতে পারে, যেন সে আমায় প্রচণ্ড ভালোবাসে..'...
-'তা এই মানুষটার ভেতরে কী তাকে পেয়েছো..'..
-'চাওয়ার বেশি হয়তো গেছি...'..-
'আমিও..'..
-'না না,আমি তোমার মত এত ভালোবাসতে পারিনা..'...
'-মোটেও না..তুমিই বেশি..'
..-'তুমি...'...
'- না,তুমি..'..
-'বেশ.. তুমি.. ওকে..থামো.. আর এবার আমায় ছাড়ো,মা চলে আসবে যে..'
সত্যি আর এক মিনিট যদি একে অপরকে জড়িয়ে থাকতো নিঃঘাত লজ্জা পেতে হত ওদের দুজনকে।
সন্ধ্যের টিফিন সেরে তথাগত আর বসলো না। বাড়ি ফেরার জন্য বেরিয়ে পড়লো। তথাগতর বাইক চলে যাওয়ার পরও নেহা অনেকক্ষন সেই রাস্তার দিকে তাকিয়েই রইলো। মা বাপির কাছে আর দুদিনের বেশি মন টিকলোনা নেহার।
ওর মা বললো-'তুই যে থাকবি বলে এলি রা..'..
-'মা পরের বার এসে থাকবো হ্যাঁ..আর তুমি তো বলছো পা টা কমেছে..'..
ওর মা ওর বাবার দিকে চেয়ে হাসি মুখে বললো-'দেখেছো যে মেয়ে এই ঘর ছেড়ে কোথাও যেতে চাইতো না,সে মেয়ে এখন আর এ ঘরে থাকতেই চাইছেনা...' ...
-'মা,তুমি না..' মায়ের কথায় লজ্জা পেলো নেহা।লজ্জায় মায়ের বুক জড়ালো।
তথাগতই এসেছিলো নেহাকে আনতে। বাড়ি ফিরে যেতেই নেহাকে দেখে ওর শ্বাশুড়িমা অবাক।
-'তুমি যে বললে কদিন থাকবে, মায়ের পায়ে ব্যথা।
-'মায়ের পা টা কমেছে।আর ওখান থেকে আমার স্কুলে যেতে অসুবিধাও হচ্ছিলো,তাই চলে এলাম।' ..
-'কিন্তু খোকাতো আমায় কিছু বললোনা,আমি আমাদের মত রুটি তৈরি করেছি..জানলে..।'
তখন পাশ থেকে তথাগত বললো-'তাতে কী আমারটাতেই দুজনের ভাগাভাগি করে হয়ে যাবে.. চলো,বড্ড খিদে পেয়েছে দুজনের।'
তথাগতর মা রান্নাঘরের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিজের মনে মুচকি হাসলো। তথাগতর বাবাও যে তথাগতর মতই ছিলো একদম। অন্তরের মিল থাকলে অনুরাগ যে এমনই হয়..কেউ কাউকে না দেখে থাকাই যায়না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন