শ্রাবণের এক একটা দিনেই বোধহয় অমন বৃষ্টিপাত হয় যাকে রিমিঝিমি বৃষ্টি নাম দেওয়া যায়না।যেমন প্রবল তার গতি, তেমনই প্রাবল্যতা তার শব্দে।
অঝোরে বৃষ্টির মাঝে স্ট্যান্ডে বাসটা এসে দাঁড়াতে জনা সাতেক যাত্রী ছোটো গেটটা দিয়ে একটু ঠেলাঠেলি করে কোনোমতে তাদের হাতের ছাতাগুলোকে ফুটিয়ে রাস্তায় নেমে এলো।আর সব শেষে নামলো আরও দুজন মেয়ে।
কিয়ান বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েছিলো ওর বাড়ি ফেরার রুটের বাসের অপেক্ষায়।শেষের দুটো মেয়ে ওই বাস থেকে নামবার সময় কিয়ানের চোখে পড়লো ওদের দুজনের মধ্যে কারো একজনের ব্যাগ থেকে ছাতা বের করতে যেয়ে কোনো একটা জিনিস জল মগ্ন রাস্তায় পড়ে যেতে।কিন্তু,দুজনে প্রায় একসঙ্গেই নামায় জিনিসটা যে কার পড়েছে সেটা সে বুঝতে পারলোনা।
-'এই যে ম্যাডাম শুনছেন।ম্যাডাম..ও ম্যাডাম...।'
বৃষ্টির দারুন শব্দে কিয়ানের কথাগুলো দুজনের কারোর কানে গেলোনা।ওদের মধ্যে একজন অটো স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে গেলো।অন্যজন হাঁটা দিলো অন্য রাস্তায়।কিয়ান ছাতা মাথায় বাসটা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো, সেখানে পৌছে রাস্তার এক বেগদা জলে ভাসমান লাল রঙের কৌটোটা হাতে তুলে নিয়ে অটো স্ট্যান্ডের দিকে যাওয়া মেয়েটার দিকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো।
-'ম্যাডাম আপনার বোধহয় এই জিনিসটা ব্যাগ থেকে পড়ে গেছে।'
হাতের লাক কৌটোটা মেয়েটাকে দেখিয়ে কথাটা বলল কিয়ান।মেয়েটা উত্তর দিলো-
-'না দাদা এটা আমার নয়।'
কিয়ান বলল-
-'আপনার নয়?তাহলে নিঃশ্চই ওই ম্যাডামের হবে।'
কথাটা বলে তৎক্ষনাৎ অটোস্ট্যান্ড থেকে ফিরে অন্য মেয়েটার খোঁজ করতে গিয়ে কিয়ান মেয়েটাকে আর রাস্তার কোথাও দেখতে পেলোনা।কিছুক্ষন এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজির পর ওর বাড়ি ফেরার বাস এসে পড়ায় কৌটোটা সাবধানে ব্যাগের মধ্যে গুছিয়ে রেখে বাসে উঠে পড়লো।
ভরা শ্রাবণের মধ্যে একবার মেয়েটার মুখশ্রী খানা দেখলেও মেয়েটার মুখটা তার মনে ছিলো।কিন্তু,যতই মুখ চেনা হয়ে থাকুক,নাম অথবা পরিচয় কিছু একটা না জানলে জিনিসটা ও তাকে ফেরত দেবে কীকরে?বাসে যেতে যেতে এই চিন্তাই মাথায় এলো।
কথায় বলে-অপরের জিনিস না বলে দেখা অপরাধ।তাই বাড়ি ফিরে কৌটোটা খুলে দেখবার তার আর সাহস বা ইচ্ছা কোনোটাই হলোনা।কিন্তু,ও আন্দাজ করতে পেরেছিলো অমন কৌটোয় সাধারনত আংটি থাকে।
পরদিন কিয়ান বাসস্ট্যান্ডের সামনে অপেক্ষা করেছিলো যদি মেয়েটা বাইচান্স আংটিটার সন্ধান করতে ওখানে আসে কিম্বা ওই সময়ের ওই রুটের বাস থেকে নামে।কিন্তু,মেয়েটা কী আর অত জেনে বসে ছিলো যে আংটিটা সে কোথায় হারিয়েছে।
কিয়ানের অপেক্ষার কোনো ফল হলোনা। কয়েকদিন অপেক্ষা করলো। তাও,মেয়েটার আর দেখা না পেয়ে কী করবে কী করবে ভেবে ফেসবুকে মেয়েটার ছবি খুঁজতে আরম্ভ করলো। নাম তো জানে না। যদি ভাগ্যবশত মেয়েটার ছবি বেরিয়ে যায়। না,তাতেও কোনো কাজ হলোনা। সব চেষ্টাই তার বৃথা গেলো পরপর।
থানায় জানানোর ইচ্ছেটা প্রথমে থাকলেও এমন ছোটোখাটো কেসে পুলিশ ওকে কতটা কী সাহায্য করতে পারবে এই সন্দেহের বশে কিয়ান জিনিসটা নিজের কাছেই যত্ন করে রেখে দিলো এই ভরসায় যে মেয়েটার সন্ধান ইশ্বরই ওকে এনে দেবে।
ঘটনার পর প্রায় মাসখানেক কেটে গেছে। কিয়ান সেদিন অফিসের বাইরের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে একলা মনে চা সিগারেট খাচ্ছে। চা দোকানের থেকে একটা দোকান পরেই একটা ইমিটেশনের গহনার দোকান আছে। ওর অন্যমনস্কতার জন্য খেয়ালটা পড়েনি, যখন সিগারেট ও রাস্তায় ফেলে দিয়ে চা দোকানিকে টাকা দিতে যাবে, আচমকাই ওই মেয়েটাকে দেখলো পাশের গহনার দোকানটা থেকে মেয়েটা বেরিয়ে কে একজন মেয়ের স্কুটিতে উঠে বসলো। যতক্ষনে ও--'ম্যাডাম,ও ম্যাডমা...' বলে হাত নাড়িয়ে তার পিছু ডাকলো,ততক্ষনে স্কুটিটা কিয়ানের দৃষ্টির থেকে দূরে চলে গেলো।কিয়ান জামার হাতাটা খুলে দিয়ে 'ধ্যাৎ' বলে হাতটা ঝিনকে বিরক্তি প্রকাশ করলো।
কিয়ান চা দোকানির থেকে আর একটা সিগারেট নিয়ে ধরিয়ে মাথাটাকে শান্ত করে ভাবলো- দ্বিতীয়বার যখন দেখা হয়েছে, নিঃশ্চই আবারও মেয়েটার দেখা সে পাবেই পাবে।সেদিন বাড়ি ফিরে এসে সেই কৌটোটা আলমারি খুলে আর একবার দেখে নিলো ঠিকঠাক জায়গায় আছে কিনা।
এ ঘটনার তিনদিন পর কিয়ানদের বাড়িতে বিপদ তারিনী পুজো ছিলো। ওর মা ওকে সকালাই ঘুম থেকে ঠেলা দিয়ে তুলতে তুলতে বলল-
-'ওই একবার বাজারে যা।দুটো দুটো করে কয়েকরকমের ফল নিয়ে আয় শিগ্রী।পুরুতমশাই চলে আসবে এখুনি।'
কিয়ান ঘুম ঘুম চোখে বলল-
-'ভাল্লাগছেনা এখন।পরে যাইনা একটু।'
কিয়ানের মা বলল-
-'তোর বিয়েটা এবার দিয়ে দিতে হবে শিগ্রি।নইলে জব্দ হবিনা দেখছি।ওঠ বলছি...।'
মায়ের বারংবার কানের সামনে 'ওঠরে... ওঠ' করার ফলে ও বাধ্য হয়ে পুজোর কেনাকাটির ব্যাগটা নিয়ে বাজারে গেলো।
ওদের বাজারে একদম শেষ সীমান্তে ফলওলাগুলো বসে। কাঁঠালি কলা, লেবু, আপেল,শসা আর কী যেন...আর কী যেন...ভাবতে ভাবতে হঠাৎই বাজারের অন্যপ্রান্তে দশকর্মার দোকানের সামনেতে একটু অস্পষ্টভাবে কিয়ান ওই মেয়েটার মুখ চিনতে চিনতে পেরে,সামনের লোক জনের ভীড় ঠেলেঠুলে দশকর্মার দোকানের দিকে ছুটলো।
ফলওলা ওকে ছুটতে দেখে চেঁচিয়ে উঠলো-'আরে ও দাদা।টাকাটা দিয়ে যান।'
বলে 'দাঁড়ান''দাঁড়ান' স্বরে কিয়ানের পিছু নিলো।
সেই দশকর্মার দোকানের কাছে হাঁপাতে হাঁপাতে পৌছে দেখে যে মেয়েটা উধাও।মেয়েটাকে পেয়েও ফের হারিয়ে ফেলে ও আবার বিরক্তি ভরা সুরে নিজের মনেই বলে উঠলো-
-'কেনো গড,আবার কেনো...'
ঠিক তখন ফলওলাও হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে কিয়ানের সামনে এর দাঁড়িয়ে-'কী দাদা..টাকা না দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন।'
কিয়ান তাকে ফলের টাকা দিয়ে বলল-'আরে দেখোনা..উফফ।সরি..।'
কিয়ান দশকর্মার দোকানে ঢুকে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলো-
-'দাদা,যেই মেয়েটা একটু আগে আপনার দোকানে এসেছিলো,ওকে আপনি চেনেন?'
দোকানদার বলল-
-'না না।কে কখন আসে,কাকে চিনবো অত।'
এমন সময় কিয়ানের ফোনটা বুকপকেটে রিং করে উঠলো।কিয়ান দেখলো বোন ফোন করেছে।ফোনটা তুলতেই ওর বলল-
-'দাদা কোথায় তুই?আয় তাড়াতাড়ি।পুজো করতে এসে গেছে।'
কিয়ান একটু মেজাজ হারিয়ে বলল-
-'আসছি রে বাবা।'
বাড়ি ফিরতেই মা একটু গলার স্বর উঁচিয়ে বলল-
-'পুরুত মশাই বসে থেকে থেকে চলে গেলেন তো।তুই না....এবার আবার কখন উনি আসবেন।'
ওর বোন পাশ থেকে টোন কেটে বলল-
-'তোমার ছেলেতো এখন উড়ছে মা...'
বলেই সেখান থেকে চলে যাওয়ার উপক্রম করলো।
কিয়ান তখন ফলের ব্যাগটা রেখে দিয়ে বোনের পিছু ছুটে গিয়ে-
-'দাঁড়া তুই...উড়ছি আমি? শুধু মায়ের কাছে আমার নামে কলকাঠি নাড়া। আজকে একবার পাই..।'
তারপর বেশ কয়েকসপ্তাহ পাড় হয়ে গেলো। আশ্বিন মাস পড়েছে। দোকানে দোকানে পুজোর কেনাকাটি বেড়েছে। কিয়ান ওর বোনকে সঙ্গে করে বড় শাড়ির মার্কেটে পুজোর শাড়ি কিনতে করতে বেরিয়েছিলো।মেয়েদের পছন্দ করা বলে কথা।নিজের আর মায়ের জন্য দুটো শাড়ি পছন্দ করতে করতেই ওর বোনতো প্রায় তখনই একঘন্টা সময় লাগিয়ে দিয়েছে। কিয়ান ওর বোনকে জিজ্ঞেস করলো-
-'তোর কী দেরী হবে?আমি তাহলে বাইরের দিক থেকে আসছি একবার।'
ওর বোন তখন সবার সামনে ঠোঁটের ওপরে দুটো আঙুল দিয়ে সিগারেট ধরার মত ভঙ্গি করে ওকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো-
-'ঠিক সিগারেট খেতে যাচ্ছিস?'
কিয়ান ওর চোখের পাতা বড় বড় করে ইশারাতেই যেন জবাব দিলো-
-'আবার পাকামো করে,তুই তোর কাজ কর।'
ওই জায়গাটার চারিদিকেই শাড়ির দোকানের পর দোকান শুধু।কিয়ান রাস্তা পেরিয়ে ওপারে একটা গুমঠিতে গিয়ে সিগারেট কিনে ঠোঁটে নিলো।টানছে টানছে এমন সময় প্রতিবারের মতন আচমকাই ওর সেই মেয়েটাকে চোখে পড়লো।হাতে বড় বড় ব্যাগে শাড়ির দোকানের নাম দেখে বুঝলো ওই শাড়ি সেও শাড়ি কিনেই বেরিয়ে যাচ্ছে।
হাতের সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে যেতে যাবে কী রাস্তায় জ্যাম।এদিক ওদিক দাঁড়ানো গাড়িগুলোকে পাশ কাটিয়ে যেতে করতে মেয়েটা প্রতিবারের মতই হাওয়া হয়ে গেলো।কিয়ান স্থির করলো এইবার আর নয়, মেয়েটার ঠিকানাটা ওকে খুঁজে বের করতেই হবে।তাই মেয়েটার সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে সোজা সেই শাড়ির দোকানটায় গেলো,যেটার নাম সে মেয়েটার হাতের ব্যাগে দেখেছিলো।ওর বিশ্বাস হলো কী,মেয়েটার ঠিকানাটা শাড়ির দোকানি নিশ্চিত দিতে পারবে।
হ্যাঁ,ওর বিশ্বাসের জয় হলো।দোকানির কাছ থেকে ও মেয়েটার বাড়ির ঠিকানা পেলো।এবং এও জানতে পারলো -মেয়েটা তার বিয়ের জন্য কেনাকাটি করতে এসে ছিলো।ঠিকানাটা লিখে নিয়ে কিয়ান ওর বোন যে দোকানে শাড়ি কিনছিলো সেই দোকানে ফিরে যেতে ওর বোন বলল-
-'কোথায় চলে গেসলি বলতো? দে,তিন হাজার টাকা বিল হয়েছে।'
বাইকে বাড়ি ফেরার পথে কিয়ানের বোন ওকে বলল-
-'কী ব্যাপার বলতো তোর?ক'দিন ধরে লক্ষ্য করছি তোর ভোল বদলে গেছে। ডাল মে কুছ তো কালা হ্যায়?'
কিয়ান বলল-
-'কোথা থেকে আমার লেডি ডিটেকটিভ এলেন রে ওকে আমার ওপর নজরদারি করতে হবে।'
ওর বোন তখন ওর পিঠে চাপড়ে দিয়ে বলল-
-'বলনা কী কেস?লাভ কেস নাকি?'
কিয়ান ওর বোনের বকবক বন্ধ করতে সত্যি ঘটনাটা জানালো।এবং এও জানালো মেয়েটাকে ও কয়েকবার দেখতে পেয়েও হারিয়ে ফেলেছে।ওর বোন তখন বলল-
-'এ তো পুরো সিনেমার গল্প রে।আমায় আর গুল মারার জায়গা পাসনি?'
কিয়ান বলল-
-'এসব কী সব ও চটেপনা ভাষা।দুদিন পর বিয়ে দিয়ে দোবো ভাবছি।শ্বশুরঘর গেলে কী বলবে ওরা?'
ওর বোন বলল-
-'তোর মত আমি স্টুপিড নয় যে কারোর সাথে একটা প্রেম ট্রেম করে রাখবোনা।সে ছেলে জানে এই তৃষা কেমন মেয়ে।'
কিয়ান বাইক চালাতে চালাতেই একবার বোনের দিকে চেয়ে লম্বা স্বরে বলল-
-'কীইইইইইইই..মা কে শোনাচ্ছি আজই।'
ওর বোন বলল-
-'মা ও জানে।শুধু তুই জানিস না।আচ্ছা, ছাড়না, বলছি যেটা বললি এখন,সত্যি বললি?'
কিয়ান জানালো ও যা বলল সেটাকে সিনেমার ভাষায় বললে বলা হবে-সত্য ঘটনা অবলম্বনে। সেদিন সন্ধ্যে হয়ে যাওয়ায় সেই মেয়েটার বাড়ির ঠিকানার তার জিনিসটা ফিরিয়ে দিতে বেরোলোনা।
পরদিনই অফিস সেরে এসে কিয়াম মেয়েটার বাড়ির ঠিকানা ধরে পৌছে দেখে, মেয়েটাদের বাড়ির গেটে তালা ঝুলছে। কী ব্যাপার? কোথাও বেরিয়েছে নাকি -দরজায় তালা কেনো পাশের বাড়ির একজকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে সে জানালো-
-'আহির তো ক'দিন পর বিয়ে।'
কিয়ান জিজ্ঞেস করলো-
-'সে তো জানি। কিন্তু গেছেটা কোথায়? কেনাকাটি করতে?'
ছেলেটার কিয়ানের প্রশ্ন শুনে সন্দেহ হলো।এত বেশি খোঁজ খবর করছে কেনো? সন্দেহ মেটাতে সে বলল-
-'তুমি কী আহির বন্ধু?'
কিয়ান বলল-
-'ঠিক বন্ধু না।তবে পরিচিত।ওর একটা জিনিস ওকে দেওয়ার ছিলো।তাই এসে ছিলাম।'
এবার ছেলেটার চোখমুখ থেকে সন্দেহের ভাব সরে যেতে সে বলল-
-'ওর তো মামাবাড়ি থেকে বিয়ে হচ্ছে।তোমায় বলেনি হয়তো।তাই ক'দিন আগে চলে গেছে।'
এবার কিয়ানের চোখ উল্টে গেলো।কারোর সাহায্য করতে গেলে বুঝি এত ঘুরতে হয়!কিয়ান ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলো-
-'মামাবাড়িটা কোন জায়গায়? মানে আমারও তো ওর বিয়েতে নিমন্ত্রন আছে।যেতে হবে।'
ছেলেটা আহির মামাবাড়ির ঠিকানাটা কিয়ানকে দিয়ে একগাল হাসি মুখে বলল-
-'বিয়েতে যাচ্ছো তো।আমিও যাচ্ছি।আহিকে কিন্তু জানাবে,আমি তোমার কত উপকার করেছি।'
কিয়ান হাসিমুখে ঘাড় নাড়লো বটে,কিন্তু মনে মনে বলল(সালা উপকার করতে গিয়ে আমার পিছন.....হয়ে যাচ্ছে,আর উনি...। নেহাত ভালো ছেলে আমি নয়তো...)
অফিসের কাজে কিয়ানের মন বসছিলো না।আহি-এই নামটা শোনার পর থেকেই।আহা!কী মধুর নাম।শুনলেও যেন প্রান জুড়ায়।মেয়েটার যদি বিয়েটা না লাগতো না,জিনিসটা তাকে ফিরিয়ে দিয়ে একবার
চেষ্টা করে দেখা যেত মেয়েটার প্রেমে পড়তে।কখনো তো কারোর প্রেমেই পড়া হলোনা।ইসসসস..হাতছাড়া করে ফেললাম এমন অনন্য নামের অধিকারীনিকে।
এই সমস্ত কথাই তার মগজে ঘুরে ফিরে আসছিলো।রাতে স্বপ্ন এলো সে একজন অপরূপার ভালোবাসায় বিভোর হয়ে পড়েছে।মেয়েটাও ওকে তার ভালোবাসা উজার করে দিচ্ছে।খুব সকালে স্বপ্ন ভেঙে দু চোখ থেকে ঘুম সরে যেতেই ও ঠিক করলো সেদিনই ও অফিসে লিভ নিয়ে আহির যত্ন করে আগলে রাখা জিনিসটা তাকে তার মামাবাড়ির ঠিকানায় ফিরিয়ে দিয়ে আসবে।নয়তো,এই সব ভিত্তিহীন স্বপ্নগুলো তার সমস্ত কাজের মাঝে ডিস্ট্রাব করছে।
একটু বেলার দিকে কিয়ান মা কে কোলকাতা যাচ্ছি বলে বেরিয়ে গেলো।বেরোনোর সময়ও ওর বোন ওর পিছনে লাগতে ছাড়লো না।মা কে প্রণাম করেনি বলে ওর বোন বলল-
-'দেখছো মা,তোমার ছেলে কেমন মা কে আজকাল প্রণাম করে বেরোতেও ভুলে যাচ্ছে। দুদিন পর বিয়ে হলে,তোমাকে আর চিনতেই পারবেনা।'
মাও বোনের সাথে তাল মেলানোর আগে কিয়ান ওর মা কে প্রণামটা সেরে নিলো।ওর মা বলল-
-'যে কাজে যাচ্ছিস,সফল হো বাবা।দুগগা.. দুগগা..।'
কিয়ান ওর বোনের সামনে গিয়ে ওর গাল দুটো টেনে ফিসফিস করে বলল-
-'সেই মেয়েটার জিনিসটা ফেরাতে যাচ্ছি বুঝলি।'
ওর বোনও গলার স্বর নামিয়ে বলল-
-'দেখিস,আবার ফেরাতে গিয়ে যেন মন দিয়ে চলে আসিস না।'
কিয়ান এবার গলা উঁচিয়ে বলল-
-'নো চান্স।'
ওর বোন বলল-
-'কেনো কেনো?'
কিয়ান- 'আসছি..পরে বলবো' বলে চলে গেলো।
ওদের মা বলল-
-'কী ব্যাপাররে তোদের?'
কিয়ানের বোন মজার সুরেই ওর মাকে বলল-
-'নট পাসিং দ্য গুপ্ত কেস...বললে পরেই গল্প শেষ।'
ওর মা বলল-
-'কী যে বলিস মাথামুণ্ডু কিছু বুঝিনা আমি।'
মেয়েটার মামাবাড়ির ঠিকানা খুঁজে কিয়ানের তখন পৌছতে প্রায় দুপুরের গায়াগায়ি। অপরিচিত একজনকে বাড়িটা কোথায় জিজ্ঞেস করতে সে ব্যাক্তি ওকে বাড়িটা চিনিয়ে দিলো।বাড়ির প্রধান দরজায় গিয়ে কলিংবেলের সুইচ টিপতে যাবে,এমন সময় ওর কানে ভেসে এলো কথা কাটাকাটির শব্দ। কান পাতা উচিত নয় ঠিকই,কিন্তু ভেতরের মানুষগুলোর উত্তপ্ত কথাবার্তা স্পষ্টই ওর কানে এলো।কথাগুলো কিছুটা এরকম-
মেয়েলি কণ্ঠে কিয়ান শুনলো-
-'ওই ছেলেকে বিয়ে করবিনা মানে কী?'
এবার একটা পুরুষ কণ্ঠে শুনতে পেলো-
-'বুঝতে পারছোনা তুমি,ও ইচ্ছে করেই এনগেজমেন্ট রিংটা লুকিয়ে রেখেছে। ও চায় ওর বিয়েটা ওই ছেলেটার সাথে যাতে না হয়।'
এবার নতুন একটা মেয়েলি কণ্ঠ কিয়ানের কানে এলো।কিয়ান বুঝলো ওটা আহির গলার স্বর।
-'ছেলেটার আচার আচরণ আমার ভাল্লাগছেনা।তোমরা কেনো এটা বুঝতে পারছোনা।'
না,আর নয়। এসব চলতেই থাকবে। কথাটা চিন্তা করেকিয়ান দরজায় কলিংবেল বাজালো।মুহূর্তে ভেতরের গলার স্বরগুলো শান্ত হলো। দরজাটা খুলতেই কিয়ান দরজার ওদিকে আহিকে দেখতে পেলো।তার আগে কিয়ান ওকে যতবার দেখেছে, ঠিক মত দেখবার সুযোগ পায়নি।সেই প্রথমবার আহিকে পরিপূর্নরূপে দেখে কিয়ানের চোখের ভাষাই বদলে গেলো। এত মাধুর্য আহির মুখের কোমলে।কিয়ানের মনে হলো আহিকে ইশ্বর যেন তুলির প্রলেপনে কোনো জীবন্ত ক্যানভাসে তৈরি করেছেন।আহির প্রশ্নে কিয়ানের মোহ ভঙ্গ হলো।
আহি জিজ্ঞেস করলো-
-'কে আপনি?'
কিয়ান সেই লাল কৌটোটা তার হাতে দিয়ে বলল-
-'এটা বোধহয় আপনার তাইনা?'
তারপর আহি কিয়ানকে জিজ্ঞেস করতে-
-'কোথায় পেলেন এটা আমি?'
কিয়ান কৌটোটা পাওয়ার পর থেকে কী কী ঘটনা ঘটেছে, যা আহি জানেনা,সেসব গল্পের আকারে আহিকে জানালো। আহি অবাক হয়ে সমস্ত ঘটনার বিবরন শুনে সেই মুহুর্তেই কিয়ানের প্রতি ভালোলাগাতে বিভোর হলো। এমন একটা ছেলেকেই যে জীবনে সে প্রত্যাশা করে,যাকে সহজেই বিশ্বাস করা যায়। আহি ফিঙ্গারক্রস করতে করতে কিয়ানকে জিজ্ঞেস করলো-
-'আপনি কী বিবাহিত?'
কিয়ান বুঝতে পারলোনা আহি তাকে প্রশ্নটা কেনো করলো। সে তাও উত্তর দিলো-
-'না ম্যাডাম।'
আহি তখন তার মা বাবার মতামত ছাড়াই সেই লাল কৌটোর মধ্যে থাকা এনগেজমেন্ট রিংটা কিয়ানের হাতে পরিয়ে দিয়ে বলল-
-'আমাকে আপনি স্বীকার করুন প্লিজ।এরা আমার জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে।'
এটা কিয়ানের কাছে একদমই অপ্রত্যাশিত ছিলো। সে আহিকে স্বীকার করে নিলো।ওর মা বাবা বাধা দিতে আসলে কিয়ান ওদের জানিয়ে দিলো-
-'ও এখন থেকে আমার স্ত্রী।বাধা দিলে আমি কিন্তু পুলিশের সাহায্য নিতেও পিছ পা হবোনা।'
কিয়ান আহিকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির উদ্দ্যেশে বেরিয়ে পড়লো। কী ফেরত দিতে এসে ছিলো আর কী নিয়ে ফিরলো-এটাই অদৃষ্ট।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন