Breaking

রবিবার, অক্টোবর ১৫

ভালোবাসা ও বিশ্বাস





 সাথী সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে বছর দুয়েক হলো অন্যত্র ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে আছে।সোমের সঙ্গে ওর প্রেমটা চলছে আজ বছর ছ'য়েক।অনেক বার দুজনের মধ্যে মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে,তবে সম্পর্ক ভেঙে যায়নি।আসলে,ওরা যে,কেউ কাউকে ছেড়ে বেশি দিন থাকতে পারেনা।দুজনেই দুজনের অভ্যেসে পরিনত হয়েছে বলা চলে।তবু,ওরা কেউ কাউকে হৃদয় দিয়ে ছাড়া শরীর দিয়ে ছুঁয়ে দেখেনি।



ওরা মানতো,শারীরিক মিলনে নিঃস্বার্থ প্রেমের নিয়ম ভঙ্গ করা হয়,তাতে করে ভালোবাসা ভাঙতে পারে।
না,ওদের প্রেমটা স্কুল বা কলেজের প্রেম না।একই পাড়ায় দুজনের বাড়ি,ছোটো থেকে চেনা জানা,তাই মেলামেশা করতে করতে কখন যে প্রেমটা হয়ে গেছে তা বুঝে ওঠার সময় পায়নি।কারন দুজনেই দুজনকে
খুব সহজে এক্সেপ্ট করে নিয়েছিলো।




সোম বাবার বই এর ব্যবসা সামলায়।সাথী চাকরিটা পাওয়ার পর থেকে ওদের ফোনে এবং মনে যোগাযোগ থাকলেও চাক্ষুষ সাক্ষাৎ প্রায় হয়ই না।এমনিতে যদিও সাথী বহুবার সোমকে ওর ওখানে ঘুরে আসতে বলেছে কিন্তু,সোম যায়নি।সোম বলেছে-'রোজই তো কথা হচ্ছে।তাছাড়া তুই ফিরলে দেখা তো হয় আমাদের।' সাথী বলেছে-'একবার এলেই কী হবে?' সোম কথা দিয়েও যেতে পারেনি।




এবার প্রায় মাস তিনেক সাথী বাড়ি ফেরেনি ইচ্ছে করেই।যাতে সোম তার সঙ্গে দেখা করতে আসে। সাথীর জন্য তার বড্ড মন কেমন করছিলো তাই বাধ্য হয়েই সে সাথীর সঙ্গে আজ দেখা করতে এসেছে।সাথী তাকে স্টেশনে আনতে গেছে।


ট্রেন এসে থামলো।সোমকে দূর থেকে চিনতে পেরে সাথী তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল-'কখন বেরিয়ে
ছিলি?'
সোম বলল-'দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে।'

সাথী জিজ্ঞেস করলো -'বাড়িতে কী বলে এসেছিস?'

সোম উত্তর দিলো-'কিছু নতুন বই আনার আছে বলে এসেছি।'
সাথী বলল-'আজ কিন্তু যেতে দেবোনা তোকে।'


সোম বলল-'তা আবার হয় নাকি?থাকবো কোথায়?'

সাথী বলল-'আমার ফ্ল্যাটে।'

সোম বলল -'তা আবার হয় নাকি?আমরা আর ছোটা বাচ্ছাটি নেই।'

সাথী বলল-'অত চাপ নিসনা তো।এক না এক দিন তো স্বামী স্ত্রী হয়েই যাবো।'

সোম বলল-'সে যখন হবো তখন হবো।'




সাথী জেদ ধরলো সোমকে আজ ওর ফ্ল্যাটে থাকতেই হবে।অগত্যা,সোম বুঝলো যে উপায় নেই,বাড়িতে আর একটা মিথ্যে বলতে হবে।
সাথী প্রস্তাব রাখলো-'চল,পাশেই একটা বড় লেক আছে।ওখানে গিয়ে বসা যাবে।কতদিন জমিয়ে গল্প করা হয়নি।'
সোমের সম্মতি থাকায় দুজনে মিলে লেকের ধারে গিয়ে নিরিবিলি জায়গা খুঁজে বসলো।




সত্যি বলতে কী দূর থেকে যতটা জায়গাটাকে নির্জন মনে হচ্ছিলো,সেখানে বসে বুঝতে পারলো,তাদের মত আরো কত জোড়ায় জোড়ায় মিলে সেখানে গোপনে প্রেম জমিয়েছে।তবে,শুধু যে গল্প করছে তা ই নয়।কারাও আবার ওড়না ঢেকে ঠোঁটে ঠোঁটে কামড়ও দিচ্ছে।বিগত ছ বছর ধরে সাথী এবং সোম একে অপরকে ভালোবাসলেও তাদের এখন পর্যন্ত একটা চুমু খাওয়ার সাহস হয়নি।সেই জন্য তারা যেন একটু আন ইজি ফিল করছিলো।




সোম বলল -'তোকে এখানেই আসতে হয়।'

সাথী বলল-'ওরা যা করছে করুক।আমাদের কী।আচ্ছা,আমার জন্য কিছু আনিসনি?'

সোম বলল-'এনেছি কিন্তু এখানে দেবো না।আজ আছি যখন পরে দিয়ে দেবো।'

সাথী বলল-'দেখি তোর হাতটা।'




সোম তাত হাতটা বাড়িয়ে দিলো।সাথী তার হাতে একটা ব্রেসলেট পড়িয়ে দিতে সোম বলল-'এটার আবার কী দরকার ছিলো?'

সাথী বলল-'আছে,আছে।অনেকদিন হলো গড়িয়েছি এটা তোকে দোবো দোবো করে আর দেওয়া হয়নি।পছন্দ
হয়েছে তো?'

সোম বলল-'লাজবাব হয়েছে।'

তারপর তারা দুজনে মন খুলে গল্প জুড়ে দিলো।
সন্ধ্যের ঠিক মুখে আকাশে তখন মেঘ জমেছে।




সোম বলল-'এবার এখান থেকে উঠে পড়া যাক।দুজনে লেক থেকে বেরিয়ে বাইরে এলো।সাথী একটা দই ফুচকার স্টল দেখতে পেয়ে বলল-'চল,ফুচকা খাবি?'

সোম ফুচকা জিনিসটা পছন্দ করেনা।তবু,সাথী খাবে বলছে বলে-' হুম চল।তবে আমি কিন্তু পাঁচটা..' সাথী
বলল-'আমি পঞ্চাশ।'সোম পাঁচটা ফুচকে খেয়ে সাথী র দিকে হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে।চোখ দিয়ে জল
বেরিয়ে যাচ্ছে,গাল ফুলে যাচ্ছে-তাও পঞ্চাশটা তো পঞ্চাশটাই খেলো।শেষে তার অবস্থা পুরো কাহিল। রুমাল দিয়ে তার হাত মুখটা সোম ই মুছিয়ে দিলো। সাথী ফ্ল্যাটে ফেরার বাকি রাস্তাটা সোমের কাঁধের ওপর ভর করে ফিরলো।



ফ্ল্যাটে ঢুকে,কিছুক্ষন টেবিল ফ্যানের নীচে বসতে সাথীর অবস্থা স্বাভাবিক হলো।বাইরে বৃষ্টি নামার তোরজোর চলছে।সাথী পাম্প চালিয়ে জল ভরতে উঠতে সোম বলল-'তুই শান্ত হয়ে বোস।আমায় বল কীসে কীসে জল ভরতে হবে।' সাথী রাজি ছিলোনা, তবু সোম পাম্প চালিয়ে বোতলে,বালতিতে আর রান্নার জন্য আলাদা জায়গায় জল তুললো।




সাথী তাকে জিজ্ঞেস করলো-'রাতে কী খাবি?'

সোম বলল-'তুই কী খাবি বল?'

সাথী বলল-'বিরিয়ানি বানাবো বলে ফ্রিজে চিকেন এনে রেখেছি।তাহলে বিরিয়ানিই বানাই?'

সোম বলল-'তোর তো বিরিয়ানি ভাল্লাগে না।'

সাথী বলল-'তুই তো ভালোবাসিস,তাই বিরিয়ানিই করবো।'




সোম বলল-'না,আজ আমি এসেছি।মানে আমি যেটা বলবো সেটাই হবে।'

সাথী বলল-'বল তবে।'

সোম বলল-' ফ্রায়ড আর চিকেন কষা।



তোর ফেবারিট।ওটাই হবে।এবং আমি নিজের হাতে বানিয়ে তোকে খাওয়াবো।' সাথীর রাজি না হয়ে উপায় নেই।রান্নার তোরজোর শুরু হয়ে গেলো।
খেতে বসবার সময় ইলেক্ট্রিক নেই।বাইরে বৃষ্টিপাত। বাতি জ্বালিয়ে খাওয়া দাওয়া সারলো দুজনে।তার পর ফ্ল্যাটের পশ্চিম দিকের ছোট্ট ব্যালকনিতে ওরা পর্দা সরিয়ে দাঁড়ালো।চারদিকে অন্ধকার।বাইরে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ।সোম একটা সিগারেট জ্বালালো।



সাথী বলল-'কাউন্টার দে।'

সোম বলল-'না না মোটেই না।এসব খেলে ফুসফুসের ক্ষতি হবে।'

সাথী বলল -'তোর জ্ঞান তুই তোর কাছে রাখ।মানে মানে দিবি কি না?'

সোম তাকে দেবেনা,সাথী নাছোরবান্দা।দুজনে যেন ধস্তাধস্তি লেগে গেলো।সাথী,সোমকে জাপটে ধরে ফেলে বলল-'দে এবার।'

সোম বলল-'না,হবেনা।'





সাথী বলল-'তবে ফেলে দে।তুইও খাবি না।'

সোম সাথীকে দেবেনা বলে সিগারেটটা ফাঁকে ছুঁড়ে দিলো।
সাথী,সোমকে সেই জড়ানো অবস্থায় বলল-'আসিস না কেনো আমার কাছে?'

সোম বলল-'এলে,এই যে এমন পাগলামি করবি বলে।'

সাথী বলল-'আমার বুঝি তোকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করেনা?'

সোম তখন নিজের হাতটা দিয়ে সাথীকে জড়িয়ে নিয়ে বলল -'আচ্ছা।আমার বুঝি করেনা?'

সাথী বলল-'মোটেও না।নইলে তুই নিশ্চই আসতিস।'





সোম বলল-'ওরে আমার পাগলি,তুই আমার বুকের মধ্যে সবসময় আছিস তো।'

সাথী বলল-'এমন করে স্পর্শ করে জড়িয়ে তো রাখিস না।'

সোম বলল-'আমাদের স্পর্শটা মনের।যা আর সবার মধ্যে নেই।'

সাথী হেসে আরও শক্ত করে সোমকে জড়ালো।সোম বাইরে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির কয়েক ফোঁটা সাথীর আদরমাখা মুখটায় ছিটিয়ে দিলো।সাথী তার ভিজে যাওয়া গাল টা সোমের গালে ঘষে দিলো।সোম বলল-'এবার চল তোর জন্যে কী এনেছি দেখাবো।'দুজনে ব্যালকনি থেকে ফিরে এলো।
সোম তার ব্যাগ থেকে সাথীর জন্য যে সালোয়ারটা এনেছিলো সেটা বের করে দিলো।সাথী গালভরা খুশি নিয়ে বলে উঠলো-'বুটিক্স এর কাজ করা সালোয়ার।'





সোম বলল-'তুই বলছিলি না একদিন ফোনে।'

সাথী বলল-'তোর মনে ছিলো?'

সোম বলল -'বেগমসাসেবা বলেছে,আর সুলতানকে মনে রাখতে হবেনা?'

সাথী বলল-'দিল খুশ কর দিয়া জাহাপনা। একবার পড়ি এটা?'

সোম বলল-'জো মর্জি আপকা।'
সাথী সালোয়ারটা পড়ে এলো ভেতর থেকে।সোম প্রদীপের নিভু আলোতেই তার দিক থেকে চোখ সরাতে পারলোনা।-'রঙটা দারুন খেলছে'- বলল সোম।সাথী হেসে বলল-'কার পছন্দ করা দেখতে হবে তো।'




হঠাৎ ইলেকট্রিক চলে এলো।সাথী তখন সালোয়ারটা ছাড়তে শোবার ঘরে ঢুকলো।দরজা খোলা।সোমের হঠাৎ সাথীর খোলা পিঠে চোখ পড়ে যাওয়ায় লজ্জা পেলো।সাথীর অমন সৌন্দর্যটা সে আগে কখনো দেখেনি সম্মোহিত হয়ে যাওয়ার খাপ। সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো এই ভেবে যে উত্তেজনার বশে কখন ভুলটা হয়ে যায়।সামলানো যে বড়ই কঠিন।



একই বিছানায় পাশাপাশি দুজন শুলো।ছাতের নীচে মিটমিট করে জোনাকির মত জ্বলা মিনিচারের মৃদু রামধনু আলোয় দুজনে তাকিয়ে একে অপরকে ঠিক একই প্রশ্নটাই করলো-'এখুনি ঘুমিয়ে পড়বি?'

দুজনে একে অপরের দিকে ফিরে আবেগ ভরা দৃষ্টি নিয়ে এমন ভাবে দেখতে থাকলো,যেন জীবনে কেউ যেন
একে অপরকে দেখেনি।




সাথী,সোমের হাতটা ধরে বলল-'কাছে আয়না।'

সোম বলল-'এর চেয়ে বেশি কাছে আসলে মিশে যাবো।'

সাথী বলল-'একদিন কি নিয়ম ভাঙা যায়না?'

সোম বলল-'ভালোবাসাটা যদি মিথ্যে হয়ে যায়।'

সাথী বলল-'অনেকেই তো নিয়ম ভাঙে।'

সোম বলল-'নিয়ম ভাঙতে গিয়ে অনেক ভালোবাসা যে ভেঙে গেছে এক রাতে।'

সাথী বলল -'মিলন হওয়া কী ভুল?'






সোম বলল-'হয়ত ভুল নেই। তবে আমি চাই,এমনই একটা বিছানা একদিন ফুলে সজ্জিত থাকবে।ভালোবাসা সেদিন কোনো বাধা ছাড়াই নিজে থেকে চাইবে মিলতে।আমরা মিলবো।'

সাথী বলল-'সে অপেক্ষা আর কতদিনের?'

সোম বলল-'নিয়ম মত ঠিক সময় এলেই আমাদের এত দিন কার অপেক্ষা শেষ হয়ে যাবে।'

সাথী বলল- 'সারাজীবন আমায় ভালোবাসবি তো?'

সোম বলল -'বিশ্বাস আছে তো আমার ওপর?'

সাথী বলল -'তুই যে কতটা বিশ্বাসী সেটা আজ আমায় আর
একবার বুঝিয়ে দিলি।'






কথাটা বলে সাথী সোমের কপালে খুব গভীরভাবে চুম্বন করে তার বুকের বালিশে মাথা রাখলো।

সোম বলল-'এই রাতটা যেন বিরাট হয় ইশ্বর।'

সাথী বলল-'হুম।আমি একটু
নিশ্চিন্তে ঘুমোতে চাই।'

দীর্ঘক্ষন কথা বলতে বলতে তাদের চার চোখের পাতায় প্রশান্তি নেমে আসলো।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন