-'মৌলি,বেরোলাম..।'
-'কোথায় পড়ানো আছে?ছাতা নিয়েছো সঙ্গে করে?'
-'হ্যাঁ,নিয়েছি।আজ আসতে একটু রাত হবে।দরজাটা এঁটে দিয়ে যাও।'
কথাটা শেষ করে সৌম্য বিকেলের টিউশনটা পড়াতে বেরিয়ে গেলো।পরপর দুটো বাড়ি পড়িয়ে,সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা থেকে তাকে আজকে আবার কানের ডাক্তারবাবুর চেম্বারে এক ঘন্টা পেসেন্ট দের নাম লেখার কাজটাও করতে হবে। তারপর বাড়ি ফেরা।ফেরার পথে সমিতির ম্যানেজার যদি চায়ের দোকানে বসে থাকে তাহলে তার সঙ্গে দেখা করে তবে ফিরবে। সৌম্যর আসল পেশা টিউশনি।কিন্তু,সংসারের খরচ খরচা আর ভবিষ্যতের কথা ভেবে সে অনেকরকম কাজের সাথে যুক্ত আছে।এই যেমন হপ্তায় দুদিন ডাক্তারবাবুর চেম্বারে রুগির নাম লেখার কাজটা, সমিতির কিছু কিছু কাজ,কিম্বা পাড়ার সাইবারক্যাফ এ যেদিন কাজের চাপ থাকে,কিছু টাকা পেলে সে সেই কাজও করতে ছাড়েনা।কোনো কাজই ছোটো নয় তার কাছে,শুধু বিয়েবাড়িতে ক্যাটারিং এর জন্য কেউ বললে যায়না।টিউশনি পড়ালেও তো শিক্ষক। একটু সম্মানে লাগে।
সব কাজ মিটিয়ে সৌম্য যখন বাড়ির দরজার এসে টোকা দিচ্ছে,মৌলি ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলো পৌনে দশটা।মৌলি দরজা খুলে দিতে সৌম্য সাইকেলের হ্যান্ডেল থেকে একটা ব্যাগ বের করে মৌলির হাতে দিয়ে বলল-'সাবধানে,ডিম আছে।'
মৌলি বলল-'ডিম আনতে গেলে কেনো,বাড়িতে তো ডিম ছিলো।'
-'আরে,তুমি বলছিলে না,হাঁসের ডিম পেলে আনতে।'
মৌলি একগাল হেসে ব্যাগটা খুলে দেখে বলে উঠলো -'হাঁসের ডিম।উফফ,আজ দুটো ভাজবো?'
-'ভাজো না।আমি কি বারণ করবো?'
ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে সৌম্য শুনতে পেলো রেডিওতে গান বাজছে।-'এই মৌলি,কোথায় রেডিও বাজছে?'
-'শোবার ঘরে।' মৌলি রান্নাঘর থেকে সারা দিয়ে বলল।
সৌম্য শোবার ঘরে গিয়ে দেখে মেঝেয় কাপড়,পুঁথি,আঁঠা ইত্যাদি সব সরানো।সে রেডিওটা বন্ধ করে দিয়ে রান্না ঘরে মৌলির কাছে গিয়ে তাকে বলল-'তুমি আবার জরির কাজ নিয়েছো?'
মৌলি বলল-'জরি কোথায়?ওতো শুধু কাপড়ের ডিজা ইনের ওপর আঁঠা দিয়ে পুঁথি বসানোর কাজ।একটা কাপড়ে একশো ষাট টাকা দেবে বলেছে।'
সৌম্য বলল -'তোমায় কী টাকা রোজগার করতে বলেছি।'
মৌলি একটু আদর ভরা সুরে বলল-'করি না।আমাদেরই তো থাকবে টাকাগুলো।'
সৌম বলল-'আচ্ছা বাবা, করো।'
মৌলি বলল-'সন্ধ্যেয় টিফিন করেছিলে?'
-'হ্যাঁ,ওই দত্তদের বাড়িতে মুড়ি দিয়েছিলো।তারপর ঘোষেদের বাড়িতে চা বিস্কুট....তুমি খেয়েছিলে?'
-'হুম।চলো এবার খেতে বসে পড়ি শিগ্রি,রাতে সানডে সাস্পেন্স শুনতে হবে।আজকে বড়দার গল্প ছিলো। শোনা হয়নি ওবেলা।'
-'আরে,তুমি ডিম ভাজলেনা? '-'কাল দুপুরে গরম গরম হাতা ভাজা করবো।তুমিও তো হাতাভাজা ডিম খেতে ভালোবাসো।'
খাওয়ার থালায় রুটি আর সোয়াবিন কষা দেখে সৌম্য খুশিতে গদগদ কন্ঠে বলল-'সোয়াবিন রেঁধেছো জমে যাবে রুটি খেতে আজ।বেশি করে রুটি করেছ তো?'
-'হ্যাঁ..হ্যাঁ..আমি জানি তুমি সোয়াবিন কষা দিয়ে ছ সাতটা রুটি খাবে।'
খাওয়া শেষ হতে,মৌলি দুবেলার খাবার বাসনগুলো মেজে মেজে দিলো, সৌম সব ধুয়ে রান্না ঘরে নিয়ে গিয়ে রাখলো। রাত এগারোটা তখন।দুজনেই ঘরের বাতি নিভিয়ে রেডিও টা টেবিলে চালিয়ে দিয়ে,মির্চিতে বড়দার গল্প শুনতে মন দিলো।
প্রথম ব্রেকের সময় সৌম্য বলল-'ওষুধগুলো ঠিক করে খাচ্ছো তো?'
মৌলি একটু মন খারাপের সুরে বলল-'আমাদের কী সত্যি সন্তান হবেনা?'
-'ডাক্তারবাবুর নির্দেশমত সময়ে সময়ে ওষুধগুলো খাও।আর একটু বিশ্বাস রাখো।'
-'কত টাকা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলো?'
-'নষ্ট কীসের? এত পরিশ্রম করা কীসের জন্য?ঠাকুর ঠিক মুখ তুলে চাইবেন দেখো।'
গল্প ফের আরাম্ভ হলো।ক্রমে ভয় ভাবটা যত বেশি ঘনীভূত হতে লাগলো,মৌলি তত যেন সৌম্যর বুকের মাঝখানটাকে উত্তেজনায় শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে লাগলো, উত্তেজনার শেষ হলো,গল্প শেষের পর।ইলেকট্রিক নিভে গেছে। মৌলি সেই জন্য হয়ত আরও ঘেমে গেছে।
সৌম্য বলল-'যত বলি ভূতুড়ে গল্প শুনবেনা..চলো,বাইরে যাবে?'
মৌলি সম্মতি জানালো।বাইরেআসতে মৌলির মুখের ঘাম রাতের স্নিগ্ধতায় মুহুর্তে মুছে গিয়ে তার ভয়ার্ত মুখখানা চাঁদের নরম আলোয় কোমলতা পেলো।
সৌম্য বলল-'ভীতুর ডিম একটা। তাও ভূতের গল্প শুনবে।'
মৌলি কথায় হার মানবেনা মনে মনে স্থির করে বলল-'আমি ভীতু না তুমি ভীতু?'
সৌম্য তখন -'পিছনে কে দেখো?' মৌলি -'ও মা গো..বলে চীৎকার করে লাফিয়ে উঠে সৌম্যকে জাপটে শক্ত করে ধরতে সৌম্য মুখের মধ্যে চাপা হেসে বলল-'ভয় কীসের?আমি আছিতো..।'
পরদিন সৌম্য বউয়ের হাতের তৈরি গরম গরম আলুর তরকারি আর কাঁচা পেঁয়াজ দিয়ে মুড়ি মেখে খেয়ে সমিতির কাজে বেরিয়ে গেলো।দুপুরে যখন বাড়ি ফিরলো,এসে দেখে মৌলি তখনও রান্নাঘরে রান্না করছে।সে হাত মুখ ধুয়ে রান্না ঘরে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলো-'কী গো?আজ এত দেরী কেনো? শরীর খারাপ নাকি?'
মৌলি বলল-'এমনি,অন্য কাজ সারতে দেরী হয়ে গেসলো।তুমি বসো,আমি এখুনি ভাত দিচ্ছি।'
সৌম্য,মৌলিকে ভালোকরে তাকিয়ে দেখে বলল-'আজ জামা কাপড় কেচেছো নিঃশ্চই?'
মৌলি বলল-'না না..।'
-'মিথ্যে বলছো কেনো?চুলে শ্যাম্পু করেছো দেখছি।তুমিতো জামাকাপড় কাচার দিন অবশ্যই শ্যাম্পু করো।'
মৌলি ধরা পড়ে গেছে বুঝে বলল-'ওই সামান্য কয়েকটা।'
-'সামান্য কয়েকটা মানে কী?তোমার না শরীর খারাপ।তুমি একটুখানি কথা শুনবেনা আমার।'
মৌলি বলল-'ঠিক আছে, এবার থেকে শুনবো।
কথাটা বলে মৌলি দুটো হাঁসের ডিম আর হাতাটা হাতে করে রান্না ঘর থেকে উনুন চালায় যেতে যাবে,সৌম্য তার হাত থেকে ডিম আর হাতাটা নিয়ে বলল-'চলো,আজ আমি তোমায় গরম ডিম ভেজে খাওয়াবো।'
মৌলি রান্নাঘর থেকে ভাতের হাঁড়ি,আর ডালের ছোট্ট গামলাটা ধরে নিয়ে গিয়ে দালানে দুজনের জায়গা করলো।নুন,তেলের জায়গা আর ডিমভাজা নিয়ে সৌম্য দালানে এসে আসনে বসে পড়লো। সৌম বলল -'নাও,এবার ভাত বেড়ে ফেলো?আজ কি ভাতে ভাত করেছো?'
মৌলি বলল-'হুম।' কথাটা বলে ভাত বাড়তে গিয়ে খেয়াল হলো থালা আনতে ভুলে গেছে। সৌম্যকে বলল-'একবার উঠে গিয়ে দুজনের থালা আনবে?' সৌম্য রান্না ঘরে গিয়ে একটা মাত্র থালা দেখতে পেয়ে-'এই মৌলি থালা কোথায়?
মৌলির মনে পড়লো,সে সকালের মুড়ি খাওয়া থালাগুলো ধুতে ভুলে গেছে।-'এখুনি ধুয়ে আনছি'-বলে মৌলি থালা ধুতে উঠেছে,সৌম্য রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল-'বসো,একটা থালাতেই দুজনের হয়ে যাবে।'
স্বামীর হাতের গরম হাঁসের ডিমভাজা খেয়ে মৌলির প্রানটা জুড়িয়ে গেলো।
একদিন দুপুর থেকে দারুন বৃষ্টি আরাম্ভ হয়েছে বাইরে।সৌম্যর পড়ানো ছিলো,কিন্তু অত বৃষ্টিতে যাওয়া সম্ভব হলোনা।জানালার পাশে দুজনে চা নিয়ে বসলো।
-'আমি হাজার দুয়েক টাকা জমিয়েছি, চলোনা এবার পুজোর সময় কোথাও বাইরে বেরিয়ে আসি।' -মৌলি, সৌম্যর কাছে আবদারের ভঙ্গিতে কথাটা বললে,
সৌম্য বলল-'কোথায় যাবে বলো?'
মৌলি বলল-'দার্জিলিং যাবে?আমার মাসি মনিরা গিয়েছিলো আগের বছর।মাসিমনি বলছিলো, সেখানে নাকি হাতে করে মেঘ ধরা যায়?'
সৌম্য মনে মনে ভাবলো,পাহাড়ে গেলে অনেক খরচ।সে তবু মৌলিকে বলল-'আচ্ছা,বেশ।ভেবে দেখবো।'
সন্ধ্যের একটু আগে বৃষ্টিটা বন্ধ হতে,সৌম্য বলল- 'যাই,অনেকদিন ক্লাবে যাওয়া হয়নি।'
মৌলি বলল-'একটা কথা বলবো?'
-'কী বলোনা?'
-'আজকে ওবেলার জল ঢালা ভাত আছে,তুমি আলুর চপ নিয়ে আসবে?'
-'ওহ,এই কথা,ঠিক আছে আনবো।'
সৌম্য মনে করে ফেরার সময় আলুর চপ কিনে আনলো।ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়ায় আলুর চপ দিয়ে আলুভাতে মেখে জল ঢালা ভাত খেতে বসে সে দুজনের মধ্যে যেন কাড়াকাড়ি লেগে গেলো।সেই ছেলেমানুষীপনার পর রাতে তাদের ঘুমটাও হলো সুখের।
কয়েকদিন পর তারা দুজনে ডাক্তারখানায় গেলো কারন মৌলির কিছু টেস্ট করানোর তারিখ ছিলো। ঠিক টেস্টের রিপোর্টের দিন মৌলিকে ডাক্তারখানায় ছেড়ে সৌম্য পড়াতে বেরিয়ে গেলো।তার আবার সেদিন সাইবার ক্যাফেতেও কাজ আছে।সন্ধ্যেয় সাইবার ক্যাফে কাজ মিটিয়ে কম্পিউটার এর সুইচ গুলো অন্যমনস্কভাবে টিপতে টিপতে তার মৌলির কথা মনে পড়লো।রিপোর্ট যদি খারাপ হয়,তবে সে মৌলিকে কীকরে সামলাবে।সন্তানের মা না হতে পারাটা যে বড়ই কষ্টের।সে একটা চেষ্টা করতে পারে মৌলির মুখে হাসি দেখতে।নিউ জলপাইগুড়ির দুটো টিকিট নিয়ে নিলো।রাতে বাড়ি ফিরতেই,দরজা খুলে মৌলি সোজা ভেতরে চলে গেলো।সৌম্য বুঝলো রিপোর্ট ভালো আসেনি।সে মৌলির মন ঠিক করতে টিকিটগুলো পকেট থেকে বের করে কোমরের পিছনে দুহাত দিয়ে লুকিয়ে ঘরের মধ্যে যেতে মৌলি তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো।
সৌম্য বলল- 'আরে,পাগলি কান্না কেনো?দেখো,কী এনেছি তোমার জন্য..'বলে টিকিটগুলো তাকে দেখিয়ে বলতে যাবে যে তারা পুজোয় দার্জিলিং যাবে,মৌলি তখন ডাক্তারের রিপোর্ট গুলো তার বুক পকেটে গুঁজে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই বলে উঠলো-
'তুমি বাবা হতে চলেছো সৌম্য।'
কথাটা শুনে সৌম্যর যেন এক মুহূর্ত নিজেকে বিশ্বাস হলোনা।সে অজান্তে হাতের টিকিটগুলো পকেটের মধ্যে চালান করে মৌলিকে বুকে তুলে দিয়ে গালে,কপালে কাঁদতে কাঁদতে অজস্র চুম্বন করতে আরাম্ভ করলো।আসলে সব কান্নাই মন ভাঙার কান্না হয়না।গভীর আনন্দেও মানুষ কাঁদে।
পরদিন সৌম্য একরাশ আনন্দ বুকে তখন টিউশন পড়াতে বেরোচ্ছে।মৌলি,সৌম্যর প্যান্টটা সাবান জলে কাচছে দেখে সৌম্য তার হাত ধরে কলতলা থেকে তুলে তাকে বলল-'এখন আর এসব তোমাকে করতে হবেনা।'
মৌলি হাসি মুখে স্বামীর কাছে একটা আবদার করে বসলো-'একজোড়া উল আর কুরুশ কিনে আনবে?'
সৌম্য জিজ্ঞেস করলো-'কেনো?'
মৌলি বলল-'তোমার জন্য একটা সয়টার বুনবো। দার্জিলিং যাবে তো..।'
তখন সৌম্যর ফের মনে পড়লো সে দার্জিলিং যাওয়ার দুটো টিকিট কেটেছিলো।কালকের খুশির খবরটা শুনে সে একদম ভুলেই গিয়েছিলো।
সৌম্য বলল-'কোথায় পেলে?'
মৌলি বলল-'তোমার প্যান্টের পকেটে।'
সৌম্য বলল-'তুমি খুশি তো?'
মৌলি ঠোঁটের ইশারায় 'হুম' বুঝিয়ে দিয়ে ঘুরে সৌম্যকে জিজ্ঞেস করলো-'তুমি?'
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন