দাদা একটা রিস্ট ওয়াচ দেখাবেন একটু জলদি।আমার ট্রেন আছে।
শিয়ালদহ স্টেশনের মধ্যে ওই যে ছোটোখাটো স্টেশনারির মত দোকানগুলো থাকে।যেখানে খুঁটিনাটি সবকিছু পাওয়া যায়,অমনই একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে উৎসব খুব অস্থির গলার স্বরে দোকানদারকে কথাটা বলতে উনি বললেন-কোন ট্রেন,দার্জিলিং মেল নাকি।তাহলে দু ঘন্টার মত সময় আছে আপনার হাতে।
উৎসবের দার্জিলিং মেলেই টিকিট আছে।দোকানদারের সে হেন কথার কারন বুঝতে না পেরে সে দোকানদারটিকে প্রশ্ন করলো- হাতে দু ঘন্টা সময় আছে মানে...?
-ট্রেন তো লেট।একটু আগেই এনাউন্সমেন্ট হয়েছে।আপনি হয়ত শোনেননি।
ট্রেন দু ঘন্টা লেট শুনেই উৎসবের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো।সকাল দশটার মধ্যে যে তাকে জলপাইগুড়ি পৌছাতে হবে।ইন্টারভিউ আছে।এমনিতেই নানা কারনে এক আধঘন্টা লেট করে দার্জিলিং মেল জলপাইগুড়ি গিয়ে পৌছায়।তার ওপর আবার ট্রেন ছাড়ার আগেই লেট।সর্বনাশ। উৎসব চিন্তা মাথায় নিয়ে দোকান থেকে হাতঘড়িটা না নিয়েই বেরিয়ে যাচ্ছিলো কী দোকানদারটি টাকে ডেকে বললো-ঘড়ি নেবেন বললেন যে..
উৎসবের দোকানদারের কথা কানে আসা মাত্র তার অন্য মনস্কতা খানিক সরে গেলো।সে পিছু ফিরে বলে উঠলো-ও হ্যাঁ..দিন..
দোকানদারটি উৎসবের দিকে কয়েকটা ঘড়ি এগিয়ে দিতে সে সেগুলোর মধ্যে থেকে একটা পছন্দ করে প্ল্যাটফর্মের আলোর দিকে ফিরে হাতে পড়ে দেখতে যাবে কী আচমকা কোথা থেকে ঝড়ের মত একজন মেয়ে এসে উৎসবের নরম হাতের ওপর তার কাঁধের ব্যাগটা দিয়ে অজান্তে দিলো এক ঝটকা।ব্যাস।উৎসবের হাত থেকে ঘড়িটাও প্ল্যাটফর্মের ওই শক্ত কংক্রিটে পড়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো।
উৎসব সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গিয়ে পিছন থেকে মেয়েটার ব্যাগটা টেনে ধরে রাগান্বিত গলায় -এই যে দাঁড়ান...যাচ্ছেন কোথায় আপনি..
মেয়েটা দৌড়ে যাওয়ায় বাধা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পিছন ফিরে দেখে একজন অচেনা অজানা ছেলে তার পিঠের ব্যাগটা টেনে ধরেছে।আর তাই দেখে সঙ্গে সঙ্গে সে তার পিঠের ব্যাগ থেকে উৎসবের হাতটা ঝিনকে সরিয়ে দিয়ে চোখ বড় বড় করে মুখে ক্ষিপ্রতার রেখা ফুটিয়ে আঙুল তুলে বলে উঠলো -আপনি আমার ব্যাগটা টানলেন কোন সাহসে হ্যাঁ..?
উৎসবের মাথায় এমনিতে চিন্তা ছিলো।তার ওপর অমন এক কান্ড ঘটে যাওয়ায় সেও নিজের মেজাজ সামলাতে না পেরে জোর গলায় মেয়েটিকে বললো -এদিকে আমার ক্ষতি করে দিয়ে পালাচ্ছেন আর আমাকেই আঙুল তুলে কথা বলছেন আপনি।
মেয়েটা তবুও আঙুল নামালো না।সে আগের মতই আঙুল তুলে উৎসবে জবাব দিলো-আমি আপনার কী ক্ষতি করে দিয়েছি হ্যাঁ। ক্ষতি তো আমার আপনি করে দিয়েছিলেন এখনই। যদি বাই চান্স আমি পড়ে যেতাম। কী অঘটনটা হতো তা কী জানেন।
উৎসব তখন মেয়েটার সাথে তর্কে না গিয়ে প্ল্যাটফর্মের মেঝেয় পড়ে থাকা ভেঙে যাওয়া নতুন ঘড়িটা হাতে তুলে এনে মেয়েটাকে দেখিয়ে বললো-দেখুন।আমার নতুন ঘড়ি।কী অবস্থা করলেন।হাতে পড়িও নি আর আপনার ঢাক্কায় নষ্ট হয়ে গেলো।পায়ে কী আপনার চাকা লাগানো আছে নাকি।এত কেয়ারলেস ভাবে দৌড়াচ্ছিলেন কেন।
-আমার কারনে হয়েছে এটা..?
-তবে না তো কী,ইনিও তো আছেন।জিজ্ঞেস করুন না। উৎসব এবার দোকানদারের দিকে দেখিয়ে কথাটা বললো মেয়েটাকে।
দোকানদারটিও সহমতি জানিয়ে জবাব দিলো -আপনার ধাক্কাতেই তো নতুন ঘড়িটা গেলো।এবার ইনি যদি না টাকা দেন আমায়।ক্ষতিটা তো আমার হয়ে যাবে তাইনা।
সত্যিটা জানতে পেরে মেয়েটা তখন শান্ত হতে বাধ্য হলো। তার তো আর কিছু বলার নেই।কিন্তু দোষও তো তার সে অর্থে ছিলোনা।সে কী জেনেবুঝে এমনটা করেছে নাকি।
উৎসব এবার দোকানদারটিকে জিজ্ঞেস করলো -এটার দাম কত..উনি মেটাবেন। -একশো পঞ্চাশ টাকা।
উৎসব মেয়েটার দিকে ফিরে বললো -বার করুন একশো পঞ্চাশ টাকা।
-আমি কেন দেবো?আমি কী জেনেবুঝে করেছি নাকি।
-সে আপনি জেনেবুঝে করেছেন কি না জেনে করেছেন আমার দেখার দরকার নেই।দিতে হবে মানে দিতে হবে।
-দেবোনা আমি।কী করবেন করুন আপনি।
ফের মেয়েটা রেগে গেলো।প্ল্যাটফর্মের মধ্যে একটা কথা কাটাকাটির পরিবেশ শুরু হয়েছে দেখে বেশ কিছু লোকজন জমায়েত হয়েছিলো সেই জায়গায়।অবশেষে ঘড়ির সেই টাকাটা উৎসবকেই দিতে হলো।আর অকারণে এতগুলো টাকা তার গচ্ছা গেলো বলে সে মনে মনে মেয়েটার প্রতি একটা খারাপ ধারণা পোষন করলো নিজের মধ্যে। উৎসব আর একটা নতুন ঘড়ি নিয়ে সেখান থেকে চলেগিয়ে প্ল্যাটফর্মের একেবারে শেষ দিকে একটা নির্জন জায়গায় গিয়ে বসলো নিজের মাথাটা একটু ঠান্ডা করতে।একেই ট্রেন লেট এই এক চিন্তা তার ওপর বিনা কারনে একশো পঞ্চাশ টাকার খেসারত।মেজাজটা সত্যি তার বিগড়ে গিয়ে ছিলো একেবারে। কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে একটা নিরিবিলিতে একাই বেশ কিছুক্ষন বসে ছিলো উৎসব,আচমকা তার কানে ভেসে উঠলো কেউ একজন তাকে যেন বলছে -কটা টাকা দেবে দাদা।সারাদিন কিছু খাইনি।
কথাটা কানে আসা মাত্র উৎসব তার বন্ধ চোখদুটো খুলে দেখে একটা বাচ্চা ছেলে,শরীরে ছেঁড়া জামা,গায়েতেও ঝুলকালি মাখা,সে হাত পেতে করুন মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে।তাকে দেখামাত্র উৎসবের বড় মায়া হলো।সে বাচ্চাটাকে জিজ্ঞেস করলো -কী হয়েছে?
-খিদে পেয়েছে।কটা টাকা দাওনা।কিছু খাবো।
উৎসব তার পার্স থেকে বের করে কুড়ি টাকা তার হাতে দিতে যাচ্ছিলো কী তার পূর্বের একটা ঘটনা খেয়াল পড়ল। একবার সে এমন একজনকে খেতে টাকা দিয়েছিলো আর সেই টাকাটা নিয়ে সে কিনা নেশা করার কাজে লাগিয়ে ছিলো।তখন থেকে এদের ওপর ওর বিশ্বাস উঠে গেছে।তাই সে বাচ্চাটাকে টাকাটা দেওয়ার আগে জিজ্ঞেস করলো- তোর কী সত্যি খিদে পেয়েছে নাকি অন্য কাজে টাকা চাইছিস?
-সত্যিই খিদে পেয়েছে।আমার ভাই আছে।টাকাটা দিলে দুজন কিছু খেতে পারি।
-কোথায় থাকিস তোরা?
-এই তো এই প্ল্যাটফর্মের পাশেই একটা জায়গায়।
-ঠিক আছে তোর ভাইকে নিয়ে আয়।আমি খাবার কিনে দিচ্ছি।
-দেবে তো সত্যি?
-হ্যাঁ দেবো।
ছেলেটা খুশি মনে তার ভাইকে নিতে গেলো।নিয়ে এসে দেখে যে উৎসব তাদের জন্য খাবার নিয়ে রেখেছে।উৎসব দুই ভাইকে দেখে তাদের দিকে খাবারটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল -এখানে বসে খেয়ে যাবি।বস এখানে।
ওদের সত্যিই খিদে পেয়েছিলো।তাই খাবারটা দেওয়া মাত্র শিগ্রিই তারা খাবারটা শেষ করে ফেললো।ওদের খাওয়া দেখে উৎসবের মায়া হলো।কত কষ্ট করে এরা জীবনের সাথে লড়াই করে চলেছে প্রতিনিয়ত।ওদের খাওয়া শেষ হলে পর ওর হাসি মুখে উৎসবের দিকে তাকিয়ে বললো-আমাদের পেট ভরে গেছে দাদা।তুমি খুব ভালো।
তখন উৎসব আরও একশো টাকা পার্স থেকে বের করে ওদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো-নষ্ট করবিনা এটা কিন্তু।কালকে এই টাকায় কিছু খেয়ে নিস কেমন।
ওরা খুশি মনে টাকাটা নিয়ে চলে গেলো।ওদের চলে যাবার দিকে উৎসব বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো কী আচমকা ওর দৃষ্টি গেলো প্ল্যাটফর্মেই কিছুক্ষন আগে আলাপ হওয়া সেই ঝগড়ুটে মেয়েটার দিকে।তাকে দেখা মাত্র সে সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নিলো।কিন্তু সে একবারও ভাবেনি যে মেয়েটা এগিয়ে এসে নিজেই তার সাথে কথা বলবে।মেয়েটা যখন দুবার পিছন থেকে তাকে আওয়াজ দিলো।সে পিছন ফিরে তাকালে পর মেয়েটা তার সামনে এগিয়ে এসে মাথা খানিক নীচু করে,চোখে চোখ না রেখে জানালো- -এক্সট্রিমলি সরি..আসলে তখন আমারই ভুল ছিলো।ট্রেনের জন্য তাড়াহুড়ো করে দৌড়াতে গিয়ে... তাই ফট করে মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিলো।কিছু মনে করবেন না প্লিজ। সরি।
-ইটস ওকে। এতটুকু উত্তর দিয়ে উৎসবও মুখ ফিরিয়ে দু পা এগিয়ে গিয়েছিলো সামনের দিকে।হঠাৎ তার কি মনে হলো, আবার পিছনে ফিরলো আর মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললো-আমিও দু:খিত আপনার সাথে অমন ভাবে কথা বলবার জন্য।মনে নেবেন না।
মেয়েটা এবার তার দিকে এগিয়ে এলো।এসে বললো-আরে না না।দোষটা তো আমারই ছিলো আসলেই।
দুজন দুজনকে সরি বলার পর উভয়ের মনের পরিস্থিতি বেশ কিছুটা স্বাভাবিক হতে প্রথম উৎসবই মেয়েটাকে প্রশ্ন করলো-তা ট্রেন কি মিস করলেন নাকি ওই ঘটনাটার কারনে?
-নাহ।আসলে ট্রেন লেট দু ঘন্টা।
-দার্জিলিং মেল নাকি?
-হ্যাঁ।আপনারও?
এবার উৎসবের ঠোঁটে ও কথাবার্তার মধ্যে একটু কোমলতা প্রকাশ পেলো।
-আমারও।দেখুন না।এতক্ষন যে কীভাবে প্ল্যাটফর্মে বসে কাটাবো।এখনও তো দেড় ঘন্টার মত বাকি। বলে সে একবার তার নতুন হাতঘড়িটার দিকে তাকালো।আর সেটা মেয়েটারও চোখে পড়লো।উৎসবের কথা শুনে ও হাতঘড়িটার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে মেয়েটা বলে উঠলো -আবার নতুন নিলেন নাকি এটা।
-হ্যাঁ।আসলে হাতঘড়িটা তাড়াহুড়োতে ফেলে এসেছি ঘরে।
-আমার জন্য আপনার অনেকগুলো টাকা নষ্ট হলো।বলুন না ওটা কত নিলো,আমি দিয়ে দিচ্ছি আপনাকে।
-আরে না না।ও বাদ দিন।কপালে যা থাকে হয়।এই দেখুন না কোনোদিন দার্জিলিং মেল লেট করেনা ছাড়তে।এবার দু ঘন্টা লেট।
-আপনিও কপাল মানেন?
-মানি এসব একটু।
মেয়েটা যে উৎসবের আঙুলের দুটো আঙটি খেয়াল করে ছিলো সেটা সে জানতে পারলো মেয়েটার দেওয়া উত্তরে-সে আপনার আঙুলে পোখরাজ আর ওই নীলাটা দেখেই বুঝেছি। উৎসব এবার নিজের হাতের দিকে একবার তাকিয়ে একটু হেসে জবাব দিলো-ওই আর কি।জীবনে কোনো কিছুই তো ঠিক হলোনা।তাই অবশেষে জ্যোতিষের ওপর ভরসা করতে হলো আর কি।
-সে যাই হোক।ঘড়িটার জন্য কত দিতে হবে আপনাকে বলুন।
-লাগবেনা।ছাড়ুন না।
-তা বললে হবে না।নিতে হবে আপনাকে।
-কী সমস্যা।পারবোনা আমি নিতে।
-আচ্ছা বেশ টাকাটা নাই নেন।আপনার ডিনার হয়নি তো এখনও?
-না।কেন?
-তাহলে আমি খাবার আনছি।এটায় না বলা যাবেনা।
মেয়েটা যে এমন যাচাযাচি করবে তা একবারের জন্য সে ভাবেনি।নাহ।মেয়েটার প্রতি তার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল ছিলো। অগত্যা সে মেয়েটাকে আর না করতে পারলোনা।ঘাড় নেড়ে চোখের ইশারায় তাকে সম্মতি দিতে সে দুজনের জন্য খাবার আনতে গেলো।যাওয়ার আগে শুধু একটাই প্রশ্ন সে করলো-বিরিয়ানি চলে তো?
-না।এত রাতে।তাও আবার ট্রাভেলে বিরিয়ানি খাই না সাধারনত।
-তাহলে রুটি তরকারি?
-হুম।এটা ঠিক আছে।তবে আপনি খামোকা আবার...
-থামুন।আমি আসছি।
উৎসব কথা বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগলো।মেয়েটা দশ মিনিটের মাথায় দুজনের জন্য খাবার নিয়ে এসে হাজির হলে পর দুজনে প্ল্যাটফর্মের একটা ফাঁকা আসনে খাবারের প্যাকেট নিয়ে বসলো।মেয়েটাই খাবার মোটামুটি সাজিয়ে উৎসবের দিকে তা এগিয়ে দিয়ে বললো-নিন শুরু করুন।
-হুম নিচ্ছি।আপনিও করুন।
দুজনে একটু একটু করে খেতে শুরু করলো।মেয়েটা যেমন ভাবে খায় সেভাবেই খাচ্ছিলো কিন্তু উৎসবকে দেখে বুঝল সে যেন একটু লজ্জা করে খাচ্ছে।তাই সে উৎসবকে বলল-আপনার কী খেতে কোনো সমস্যা হচ্ছে?
-কই, নাতো।
-নাহ।দেখে মনে হচ্ছে।আপনি আপনার মত করে খান না।
উৎসব তখন নিজের মত করে খেতে শুরু করলো।পেঁয়াজ এর টুকরো আর কাঁচা লঙ্কা না হলে রুটি খাওয়া হয়।সে সেই ভাবেই খেতে শুরু করলো।মেয়েটা ওর খাওয়া দেখে মনে মনে হাসলো আর কথাটা জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারলোনা যে-কাঁচালঙ্কা কীকরে খান বলুন তো?
-কেন?
-আমি যদি এক কামড় কাঁচা লঙ্কা খাই তো আমাকে একটা রসোগোল্লা খেতে হবে।নয়তো ঝালে মরে যাবো। কথাটা শুনে হাসলো উৎসব।হাসতে হাসতেই সে বললো-অযথাই ভয় পান।আর রুটির সাথে তো হেব্বি যায় এটা। ট্রাই করে দেখতে পারেন একবার।
-একদমই না।এত রিস্ক নেওয়াই যাবে না।
-আরে চাপ নেবেন না।আমার সাথে রসগোল্লা আছে।
-সিওর?
-হ্যাঁ।
-বেশ একবার ট্রাই করছি।
মেয়েটা একটা কাঁচালঙ্কা রুটির সাথে এক কামর দেওয়া মাত্রই ঝালে হু হা করে উঠলো।সত্যি লঙ্কাটা একটু বেশিই ঝাল ছিলো।উৎসব যা তাকে বলেনি।মেয়েটা হু হা করতে করতে- মিষ্টি,মিষ্টি.. উৎসব জলের বোতলটা তার দিকে বাড়িয়ে দিলে পর সে বললো-আরে জলে হবে না।
উৎসবের কাছে আসলেই কোনো রসগোল্লা ছিলোনা।সে ভাবেনি যে সত্যিই মেয়েটার মিষ্টি লাগবে।অবশেষ জলটল খেয়ে খানিক পর যখন মেয়েটা শান্ত হলো তখন তার মাথা কাঁচলঙ্কার ঝালের চেয়েও বেশি গরম হয়ে গেছে।-আপনি বললেন যে আপনার সাথে মিষ্টি আছে। দিলেন না কেন?
-ছিলোনা তো।আমি ভাবলাম যে..
-আপনাকে বিশ্বাস করাই তো ভুল হয়েছে দেখছি..
বলে উঠে গেলো মেয়েটা।উৎসব এবার কী করে,মেয়েটার পিছু পিছু সরি বলতে বলতে দৌড়ে গেলো।মেয়েটা না তার দিকে ফিরে দেখে আর না কোনো উত্তর করে।উৎসব তো সরি সরি করেই চলেছে।অবশেষে মেয়েটা দাঁড়িয়ে ফিক করে হেসে দিয়ে বললো-কেমন প্র্যাঙ্ক করলাম বলুন আপনার সাথে।
-এঁ...আপনি মজা করছিলেন।
-আসলে আপনাকে দেখে ডিস্টার্ব বলে মনে হচ্ছিলো তাই একটু মজা করলাম যাতে আপনার মুডটা ফ্রেশ হয়ে যায়। জাস্ট ফর ফান।তা এত চাপ নিয়ে আছেন কীসের জন্য।মানে খুব ব্যক্তিগত না হলে শেয়ার করতে পারেন।আমার আবার এক বিশেষ গুন আছে চট করে সমস্যার সমাধান করে দেওয়ার।
উৎসব মনে কোনো সংকোচ না রেখে সত্যিটা বলেই দিলো- আসলে,আমার টি ওয়ান্ডার্স এ কাল ইন্টারভিউ আছে দশটায়,মর্নিং এ।ট্রেন তো লেট।কীভাবে গিয়ে যে পৌছাবো।সত্যি বলতে কী চাকরিটার খুব প্রয়োজন আমার।
--কোথায় বললেন,টি ওয়ান্ডার্স।আচ্ছা।
-হ্যাঁ।সময় মত না যেতে পারলে তো ইন্টারভিউতে বসবার আগেই..বুঝতেই পারছেন।
-তা কাল কত তারিখ যেন?
হঠাৎ মেয়েটা তাকে এ প্রশ্ন কেন করলো উৎসব বুঝতে পারলোনা।সে তাও মেয়েটাকে জানালো-পয়লা অক্টোবর।
-আপনি তো ভাগ্যটাগ্য বিশ্বাস করেন।তাহলে এটাও জানেন হয়তো যে অক্টোবর মাসটা অনেকের জন্য ভাগ্য বয়ে আনে।
-তাই?কেন?
-কারন এই মাসে মা দুর্গা আমাদের মর্ত্যে আসেন।তাই সব কিছু শুভ হয় এটা আমার বিশ্বাস।
-মায়ের কাছে আমার জন্য তবে একটু প্রে করে দেবেন যেন সময়ে আমি গিয়ে পৌছাতে পারি শিলিগুড়ি।
-আপনার নিজের ভাগ্য আপনি নিজেই গড়ে নিয়েছেন। তার জন্য আমার প্রে লাগবে না।শুধু এটা জানবেন,কাউকে যদি কখনও সাহায্য করে থাকেন মন থেকে তবে তার পুরস্কারও আপনি একদিন ঠিকই পাবেন। মেয়েটা একথাগুলো কেন বললো উৎসবকে তা সে বুঝতে পারলোনা।তবু সে প্রশ্ন করলো মেয়েটাকে-আপনিও কী ভাগ্যে বিশ্বাস করেন?
-হ্যাঁ আবার নাও।কারোর সাথে কারোর দেখা হয়ে যাওয়ায় যদি ভাগ্য বলে কিছুর হাত থাকে তবে বিশ্বাস করি ভাগ্যকে।
দেখতে দেখতে দার্জিলিং মেল শিয়ালদহ প্ল্যাটফর্মে এসে হাজির হলো।ওরা দুজনেই দুটো আলাদা কামরায় ওঠবার আগে একবার বিদায় জানাতে কাছাকাছি এলো।উৎসবই মেয়েটাকে প্রথম হাসিমুখে বললো- এমন একটা ইন্সিডেন্টের মধ্যে দিয়ে আপনার সাথে আলাপ হবে স্বপ্নেও ভাবিনি।তবে আবার যদি কোনোদিন এভাবেই সাক্ষাৎ হয়ে যায় একসাথে বসে কফি খাবো কেমন।
-আশা করি আপনার মনের ইচ্ছে মা দুর্গা পূরন করবেন খুব শিগ্রি।ভালো থাকবেন।সেই দেখাটার অপেক্ষায় থাকলাম।
-আমিও অপেক্ষায় থাকব।
বিদায় নেওয়ার পরমুহূর্তে উৎসবের খেয়াল পড়লো যে সে মেয়েটার নামটাই জানতে ভুলে গেছে।ইসস।এমন ভুলটা যে সে কেন করলো।সারারাত ট্রেন জার্নির মাঝেও উৎসব এর নির্ঘুম চোখে মেয়েটার সাথে ঘটে যাওয়া বিগত কয়েক ঘন্টার ঘটনাগুলোই ভেসে ভেসে উঠছিলো।কী অদ্ভুত না মেয়েটা।একেবারে সবার চেয়ে অন্যরকম। আলাদাই। আবার যদি দেখা হয় তবে...ভাবতে ভাবতে তার স্বপ্নময় দুচোখের মাঝে গভীর নিদ্রা জড়িয়ে এলো। পরদিন জলপাইগুড়িতে নেমে টি ওয়ান্ডার্স এ পৌছাতে করতে সে উল্লিখিত সময়ের চেয়ে একটু দেরীতেই গিয়ে পৌছালো। যাই হোক তাকে বের করে দেওয়া হয়নি এই সৌভাগ্য তার।
ইন্টারভিউ রুমে যখন তার ডাক পড়লো,সে ভিতরে গিয়ে দেখে যিনি তার ইন্টারভিউ নেবেন তিনি আর কেউ না।গত রাতে আলাপ হওয়া সেই মেয়েটা।সে তো বিষ্ময়ে অবাক হলো।যখন তার সেই দুটো অবাক চোখে সে চেয়ারে বসলো তখন মেয়েটা হাসি মুখে তার দিকে চেয়ে বললো-
-আমিই টি ওয়ান্ডার্স এর মালকিন।গত রাতে আপনাকে দেখেছিলাম ওই স্টেশনের বাচ্চা ছেলেগুলোকে খাবার কিনে দিতে আর তখনই মনে হয়েছিলো যে আর যাই হোক আপনি মানুষটা খারাপ হতে পারেন না। বলে তার দিকে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে মেয়েটি বলল-আমি ভারতী দেব।
উৎসব ভারতী দেবের হাত স্পর্শ করে বললো-আমি উৎসব ভৌমিক।
-আপনার সব ডকুমেন্টস জমা করে দিন।আর কাল থেকে জয়েনিং করুন আমাদের টি এস্টেট কোম্পানিতে।অসুবিধা হবে না তো আপনার।
-আরে না না..আপনার জন্য আমার চাকরিটা..
-আমার জন্য না।বলেছিলাম না,আপনি আপনার ভাগ্য নিজে গড়ে নিয়েছেন।আমাদের কোম্পানিতে একজন বিশ্বস্ত ম্যানেজারের প্রয়োজন ছিলো।আর আশা করি আপনি খুব বিশ্বস্ত।
উৎসব কৃতজ্ঞতা স্বরুপ ভারতী দেবকে নমস্কার জানিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দরজার দিকে সবে গেছেন কি ভারতী দেব তাকে ডেকে বললো-পরের সাক্ষাৎ এ কফি খাওয়াবেন বলেছিলেন।ভুলে যাননি তো আবার?
-নিশ্চই খাওয়াবো।কবে খাবেন বলুন?
-আজই।তবে এই আমন্ত্রনটা কিন্তু টি ওয়ান্ডার্সের মালকিন কে না।কালকের সেই অপরিচিত মেয়েটাকে।তবেই যাবো।
-একদম..কোনো পাহাড়িয়া ক্যাফেতে বসে কুয়াশার শীতলতা মাখতে মাখতে কফির উষ্ণতা ভাগ করে নেওয়া যাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন