দুজন দুজনকে আঁকড়ে চোখের জলে সব কষ্ট ধুয়ে ফেলতে চায় যেন।
অনেকটা সময় একভাবে কেটে যায়। আস্তে আস্তে শান্ত হয় তারা।
দুজন দুজনকে ছেড়ে নিজেদের মতো বসে থাকে।
একসময় অর্ক মৃদু স্বরে ডাকে
---"ইন্দ্রা।"
-----"হুম বলো।"
-----"আমাকে ক্ষমা করে দাও।"
-----"ওকথা বোলো না। আমি তোমাকে ভালবাসি অর্ক।"
-----"তাহলেএড়িয়ে যাচ্ছ কেন? কেন দূরে সরিয়ে দিচ্ছ আমাকে?"
-----"ভালবাসলেই কাছে আসতে হবে? বিয়ে করতে হবে? এমন তো কথা নেই।"
-----"তা নেই, কিন্তু হঠাৎ এমন ভাবনা তো এমনিতে নয়। তাই না?"
-----"নয়ই তো। তোমাকে বিয়ে করতে ভয় পাচ্ছি অর্ক।"
" এমন কি করছি বলতো যে হঠাৎ তোমার সব ভাবনা পাল্টে গেল? কি এমন ভয়ের কারন ঘটল?"
ইন্দ্রাণী চুপ করে থাকে। কিভাবে বোঝাবে নিজের ভাবনা, কি করে বলবে সব, ঠিক হবে কি বলা--- এসব ভাবনা মাথায় ঘুরতে থাকে।
অর্ক আবার বলে
---"ইন্দ্রা।"
------" হুম।"
------"বলবে না আমাকে সব?"
------"তোমার শুনতে ভাল লাগবে না।"
------" না শুনেও কি ভাল লাগছে? আমি শুনব। তুমি বল।"
-----"তোমাকে ভালোবেসেছি, সারাজীবন ভালবাসব।
কিন্তু এমন বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাই না যা যে কোনো সময় ছিঁড়ে যেতে পারে।"
-----"আমাকে তোমার বিশ্বাস নেই?"
-----"তোমাকে আছে, কিন্তু তোমার মনকে নেই। তোমার মনের কথা আমি শুনে ফেলেছি যে।" -----"তুমি ভুল ভাবছ ইন্দ্রা। আমি সেভাবে কিছু বলিনি।"
-----"আমার থেকে আমার শরীরের শুচিতা যে বড় তোমার কাছে সে তো অস্বীকার করতে পার না।" -----"একটা সাধারণ কথা এভাবে ধরছ কেন?" -----"কি করব বল, তোমাকে বিয়ে করলে আমার মা হতেও যে ভয় লাগবে।"
-----"কি বলছ এসব?"
-----"জন্মেই সন্তান তো মায়ের স্তনে মুখ ডুবিয়ে বাঁচে তাইনা?"
-----"সে তো সবাই জানে।"
-----"সবাই জানে। কিন্তু তুমি, তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে তো?" -----"আশ্চর্য সন্তান মায়ের দুধ খেয়ে বড় হবে, তার সাথে চলে যাবার কি হল?" -----"হল না? এঁটো হবে না এ শরীরটা? সে তো তৃতীয় কেউ। আর তৃতীয় কারো স্পর্শে আমার এঁটো শরীরের জন্য চিরকালের মতো ছেড়ে যাবে আমাকে। কত সাবলীলভাবে বললে কথাটা। যেখানে ভাঙা এত সহজ সেখানে সম্পর্ক আর না এগোনোই ভাল নয় কি?"
------"আমি যা বলেছি তা সত্যি ধরে নিলেও তুমি সম্পর্ক ভাঙার কথা বলতে পার না।" ------"কেন পারব না। যা দিনকাল কত ঘটনাই তো ঘটছে রোজ। আজ যদি আমি ধর্ষিতা হই, কাল কি হবে আমার বলতো। ছেঁড়াখোড়া শরীর নিয়ে আত্মহত্যা ছাড়া আর কি করার থাকবে আমার?"
অর্ক এতক্ষণে ইন্দ্রাণীর মুখ নিজের দুহাতের তালুতে ধরে বলে----"ইন্দ্রা তোমাকে কোনও সাফাই দেব না, আর জোরও করব না। যদি সত্যিই দ্বিধা তৈরী হয়ে থাকে তো আমাকে বিয়ে করতে হবে না। তবে এটুকু বলব আমার কথার তুমি ভুল ব্যাখ্যা করেছ। যেদিন বুঝবে সেদিন নিজেই কষ্ট পাবে।"
-----"ভুল ব্যাখ্যা?"
-----"অবশ্যই। আমার কথার শেষটুকু ধরলে। কিন্তু প্রথমটুকু ভাবলে না। তোমার কথার পরিপ্রেক্ষিতেই বলেছিলাম তৃতীয় কারো কথা ভেব না।"
-----"আমি না ভাবলেও কিছু কখনো ঘটবে না তার কি নিশ্চয়তা আছে? "
------"তা নেই। তোমার সাথে তেমন কিছু ঘটলে সেটা আমার ব্যর্থতা।
আর দরকার হলে সারা পৃথিবীর বিরুদ্ধে গিয়েও আমি তোমার পাশেই দাঁড়াব।
কিন্তু স্বেচ্ছায় আমাকে আঘাত কোরো না।
আমি যদি স্বেচ্ছায় অন্য কারো শয্যাসঙ্গী হই তুমি মানতে পারবে তো?
পারবে না। আমার কথা বললাম। বাকী সিদ্ধান্ত তোমার।" অর্ক উঠে দাঁড়ায়।
আস্তে আস্তে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
আবার একটা দিন শুরু হয়। সব কিছু স্বাভাবিক ছন্দে চলতে থাকে।
অর্ক নিজের ঘরেই প্রায় বন্দীর মতো কাটায়।
ইন্দ্রাণী যথারীতি সব সামলাতে থাকে , শুধু অন্যদিনের মতো উচ্ছ্বাসের যেন অভাব। চোখমুখের চেহারাটাও যেন অন্য রকম লাগে।
বৃদ্ধ মেসোমশাইয়ের তা চোখ এড়ায় না।
ইন্দ্রাণীকে ডেকে পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করে--- "কি হয়েছে মা তোর? শরীর খারাপ করেছে?"
ইন্দ্রাণীর ইচ্ছে করে মনের সব জ্বালা উজাড় করে বলে দেয়।
অর্কর একটা কথা তাকে ভীষণ বিচলিত করেছিল। হয়তো সত্যিই সেভাবে সে কথাটা বলতে চায়নি। ইন্দ্রাণীর নিজেরও বোঝার ভুল হয়েছে। না হলে রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সময়ও তার চোখে জল আসত না। যতই আড়াল করতে যাক ইন্দ্রাণীর চোখ এড়ায় নি। সে নিজেও তো অর্ককে ভালবাসে। অর্ক চলে যাবার পর সে দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি। বাকী রাত কেঁদে কাটিয়েছে। হয়তো অর্কও তাই। বারবার ইচ্ছে হয়েছে অর্কর কাছে গিয়ে ভুল স্বীকার করে নিতে। কিন্তু কারো কাছে কখনো হার স্বীকার করা তার স্বভাব নয়।
মেসোমশাইকে কিছু বলতে পারে না সে।
তাকে চুপ থাকতে দেখে মেসোমশাই বলে ওঠে---"যা মা তুই বরং একটু বিশ্রাম কর।"
তারপর অর্ককে ডাকে। বলে---"শোন, মেয়েটার শরীর ঠিক নেই। কতো আর সামলাতে পারে।
অভ্যেস নেই তো। তুই যা হোক একটু করে নে। ও বিশ্রাম নিক। সন্ধ্যেবেলা একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাস।"
অর্ক মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বেরিয়ে যায়।
ইন্দ্রাণী বলে---"আমার কিছু হয়নি মেসোমশাই। শুধু শুধু টেনশন করতে হবে না।"
ইন্দ্রাণী গিয়ে রান্না শুরু করল। দাদা সকালেই বেরিয়ে গেছে। কাজকর্ম শেষ করে একেবারে দিদির ওখানে হয়ে ফিরবে।
অর্ক নিজের ঘরে গিয়ে একটু ভাবল। ইন্দ্রাণীর শরীর সত্যিই খারাপ করেছে। চোখমুখের চেহারা যা হয়েছে, অবশ্য হবারই কথা। তাকে ভুল বুঝে খুব কষ্ট পাচ্ছে ইন্দ্রা। এতো সংবেদনশীল হলে হয়?না, চিরদিনের মতো ছেড়ে যাবার কথাটা বলা তার একদমই উচিত হয়নি। ভালোবাসার জোর যখন আছে তখন ও কথা কেন? বরং জোর খাটানোর কথা বলতে পারত। সংকোচ, সংশয় কাটিয়ে নিজেকে শক্ত করে। পা বাড়ায় ঘরের বাইরে।
-----"কি হল তুমি এখানে কেন এলে?"----
ইন্দ্রাণীর প্রশ্নে অর্ক বলে---
"ঘরে গিয়ে বিশ্রাম কর, যাও।"
-----"অত আর দরদ দেখিয়ে কাজ নেই।" -----
"কি করব পিতৃ আদেশ তো মানতেই হবে।"
-----"পিতৃভক্ত হনুমান।"
-----"তুমি আমাকে হনুমান বললে?"
-----"তবে রে, দেখাচ্ছি।"
অর্ক একহাতে ইন্দ্রাণীকে বুকের সাথে জাপ্টে ধরে কামড় বসিয়ে দেয় গালে। -----"উউঃ লাগে না বুঝি? কোনো বোধ নেই?"
অর্ক ঠোঁটের কোনে মুচকি হেসে বলে---"হনুমানের বোধ তো তার মতোই হবে।"
কথাটা বলেই ঠোঁট ডুবিয়ে দেয় ইন্দ্রাণীর ঠোঁটে।
ঠিক তখনি দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। অর্ক গিয়ে দরজা খুলে দেখে ইন্দ্রাণীর বাবা দাঁড়িয়ে।
তাকে ভিতরে নিয়ে বাবার ঘরে বসাতেই জিজ্ঞেস করে -----"ইন্দ্রাণী কোথায়?"
ততক্ষণে ইন্দ্রাণী গিয়ে দাঁড়িয়েছে। '
তোর সাথে একটু কথা আছে' বলেই উঠে সে মেয়েকে নিয়ে অন্য ঘরে চলে যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন