বৃহস্পতিবার, মে ১৬

রক্ষণশীল

 আমি যে স্কুলে পার্টটাইম টিচার হিসেবে ঢুকেছিলাম, সেখানে এক ম্যাডাম ছিলেন।‌ দেখতে এতো সুন্দর, এতো মিষ্টি গলা, ব্যবহারও খুব চমৎকার।‌ অথচ তিনি বিয়ে করেননি। কেন করেননি, আমরা কেউ জানতাম না।

তার নাম ছিলো দিপ্তি। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র ছিলেন। বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। আমরা তাকে দিপ্তি আপা বলে ডাকতাম।
দিপ্তি আপার বিয়ে না করার ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের চর্চা করা উচিত ছিলো না, কারণ এটা সম্পূর্ণই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু তবুও এটা নিয়ে কথা হতো‌। আমরা বাঙালি তো, অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আলোচনা না করলে আমরা কেন যেন শান্তি পাই না। তো এরকম এক আড্ডায় জানা গেলো, দিপ্তি আপা চিরকালই যে চিরকুমারী ছিলেন, এমনটা নয়। তার একবার বিয়ে হয়েছিলো। পরে ডিভোর্সও হয়ে গেছে। সেই ডিভোর্সটা হয়ে যাওয়ার পর তিনি আর বিয়ে করেননি।
আমাদের জানার ইচ্ছা এ পর্যন্তই এসে শেষ হয়ে গিয়েছিলো। প্রথম বিয়ের তিক্ত অভিজ্ঞতার জন্যই হয়তো তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। এরপর আর কিছু বলার থাকে না। তবু আমার মহিলা কলিগেরা একটু আফসোস করতেন, তিক্ত অভিজ্ঞতার পরও তো অনেকে দ্বিতীয় বিয়ে করে এবং সুন্দর মতো সংসার করে। আপা সেই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হলেন।
যাই হোক, আপাকে এই নিয়ে আমরা কখনো আর জিজ্ঞেস করিনি।
একদিন সন্ধ্যাবেলা। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হবে। সেটার প্রশ্ন তৈরি করতে করতে আর খাতা গোছাতে আমাদের বেশ দেরি হয়ে গেলো। সবাই মোটামুটি আগেই বেরিয়ে গেলো স্কুল থেকে, আমি আর দিপ্তি আপা দুজনেরই ফ্যামিলি প্রেশার নাই বলে শেষের কিছু টুকটাক কাজের ভার পড়লো আমাদের ওপর। ওগুলো শেষ করে আমরা সবার পরে বেরোলাম। দিপ্তি আপার বাড়ি একটু দূরে, বাসে করে যান। আমি তাকে এগিয়ে দিতে গেলাম বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত। হঠাৎ আপু বললেন, 'চলো, কফি খাই।'
আমাদের স্কুলের গলির মুখে তখন একটা নতুন কফিশপ বসেছে। যারা ওখানে খেয়েছেন, সবাই বলেছেন কফিটা ওখানে খুবই ভালো বানায়, কিন্তু আমার তখনও খাওয়া হয়নি। আপার প্রস্তাবটা তাই লুফে নিলাম। আমরা দুজন গিয়ে বসলাম কফিশপে।
কফিশপে সেদিন তেমন মানুষ ছিলো না। আমরা কোণার একটা টেবিলে গিয়ে বসলাম। কফির অর্ডার দিলাম। এসময়ই হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। নভেম্বরের বৃষ্টি, এরপরই শীত নেমে যাবে। বৃষ্টির জন্য আমরাও আটকে পড়লাম কফিশপে।
বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। সেই বৃষ্টি দেখে আপা কেমন যেন আনমনা হয়ে গেলেন। অনেকক্ষণ বৃষ্টি দেখতে দেখতে হঠাৎ আমাকে প্রশ্ন করলেন, 'তুমি এখনো বিয়ে করছো না কেন?'
হঠাৎ করে এই প্রশ্ন করাতে আমি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলাম। পরে সামলে নিয়ে বললাম, 'আরেকটু গোছাই সব। তারপর করবো।'
'পছন্দের কেউ আছে?'
'নাহ। নাই।'
কফি চলে এসেছে। আমরা কফির কাপে চুমুক দিচ্ছি। এরমধ্যেই আমি আপাকে প্রশ্ন করলাম, 'বিয়ে করা কি খুব জরুরী?'
আপা হেসে বললেন, 'অবশ্যই জরুরী। এই পৃথিবীতে কেউ তো একা চলতে পারে না। একজন সঙ্গী লাগে। সেই সঙ্গী পাবার জন্যই বিয়েটা করা দরকার।'
উনার উত্তর শুনে আমি একটু অবাক হলাম। আমি ভাবতাম উনি বিয়ের বিরুদ্ধে, কিন্তু এমনটা তো নয় দেখছি। আমি তাই আবার জিজ্ঞেস করলাম, 'কিছু মনে না করলে, একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি আপা। আপনি বিয়ে করেননি কেন?'
আপা একটা লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, 'অনেক কাহিনী। কেউ বিশ্বাসও করে না। তাই বলি না কাউকে।'
'বলেন আপা। আজকে আমার কোন কাজ নাই।'
আপা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, 'তুমি বিশ্বাস করবা না।'
'কেন করবো না? অবশ্যই করবো। আপনি বলেন।'
আপা একটু চুপ করে থেকে তার কাহিনী বলা শুরু করলেন, 'বরিশাল বিএমে পড়ার সময় একটা ছেলের সাথে প্রেম হয়েছিলো। ছেলেটার নাম শান্ত। আমার জন্য তখন বাসায় ছেলে দেখছে। আমি শান্তর কথা বললাম। বাবা শান্তর পরিবারকে চিনতেন। সরাসরি না করে দিলেন। বললেন, ওদের ফ্যামিলিতে ঝামেলা আছে, ওদের চিন্তাধারা আর আমাদের চিন্তাধারা এক না। ও বাড়িতে বিয়ে করা চলবে না।
আমারও তখন জেদ চেপে গেছে। বিয়ে করলে শান্তকেই করবো।
একদিন আমরা সত্যি সত্যি পালিয়ে বিয়ে করে ফেললাম। বাবা শুনে রেগে আগুন হয়ে গেলেন। সোজাসুজি বলে দিলেন, আমি তার মেয়ে না।
আমার খুব খারাপ লাগছিলো। শান্ত আমাকে সান্তনা দিয়ে বললো, সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন এমন করলেও একসময় বাবা আমাদের মেনে নিবেন। ওর কথা শুনে একটু ভালো লাগলো আমার।
আমরা কিছুদিন শান্তদের বাড়িতে ছিলাম। সেখানে দেখলাম, বাবার কথাই ঠিক। ওদের চিন্তাধারা আর আমাদের চিন্তাধারা এক না। ওরা বেশ রক্ষণশীল।
যাই হোক, বেশ কিছুদিন ওদের বাসায় থেকে আমরা ঢাকা চলে এলাম। শান্ত একটা চাকরি জুটিয়ে নিয়েছিলো। আমার জন্যও একটা কিন্ডারগার্টেনের চাকরি জোগাড় করে দিলো। আমরা দুজনে মিলেই চাকরি করা শুরু করলাম। বেতন বেশি না, কিন্তু দুজনের বেতন দিয়ে মোটামুটি চলে যায়। ততদিন মিরপুরে এক রুমের একটা বাসাও ভাড়া করে ফেলেছি।
আমার স্কুলের চাকরি মোটামুটি চলছে। সেই স্কুলে অপু নামে একটা ছেলে ছিলো। আমার বয়সী হবে, কিন্তু আমাকে আপু আপু বলতো। একদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো, কোন রিকশা পাওয়া যাচ্ছিলো না দেখে আমি আর অপু এক রিকশায় বাড়ি ফিরলাম। সেদিন রাতে শান্ত বাসায় এসে বললো, আমার আর চাকরি করার দরকার নেই।
কেন বললো, সেদিন জানতে পারিনি। তবুও ওর কথা মেনে নিলাম। বাসাতেই থাকা শুরু করলাম। সারাদিন বাসায় থাকি, সময় কাটে না। আশেপাশের বাসার মেয়েদের সাথে গল্প করে কাটাই। আমাদের পাশের বাসায় এক ভাই ছিলেন, একটা অফিসে নাইট শিফটে ডিউটি করতেন, সকালে বাসাতেই থাকতেন। উনার বউয়ের সাথে আমার ভালো ভাব হয়ে গিয়েছিলো। উনি বলেছিলেন, ভাই নাকি ভালো রান্না করতে পারে। আমি হেসে বলেছিলাম, তাহলে আমাকে একটু শিখায় দিতে বলেন। ঐ ভাবি হেসে বলেছিলেন, আচ্ছা।
আমি তো মজা করেই বলেছিলাম, কিন্তু সত্যি সত্যি দেখি একদিন দুপুরে দুজন মিলে আমার বাসায় হাজির, একটা স্পেশাল আইটেম রান্না করবে। আমরা তিনজন মিলেই রান্না করলাম। অনেক হাসাহাসি হলো, আড্ডা‌ হলো। সেদিন রাতে শান্ত বাসায় ফিরলে আমি তাকে রান্নাটা খাওয়ালাম। শান্ত খেয়ে খুব খুশি। জিজ্ঞেস করলো, কই শিখেছি। আমি বললাম, পাশের বাসার ভাই শিখিয়েছেন। শান্ত শুনে ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেলো।‌ পরদিনই অফিস থেকে ফিরে আমাকে বললো, 'ব্যাগপত্র গোছাও। নতুন বাসা পেয়েছি। সেখানে উঠবো।'
আমি খুবই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু কিছু করার নাই। নতুন বাসায় উঠতে হলো। কিন্তু আমার মনে তখন থেকেই একটা সন্দেহ জন্মেছিলো। শান্ত মনে হয় আমার সাথে অন্য কোনো ছেলেমানুষের মেশা দেখতে পারে না।
আমিও ভাবলাম, ঠিক আছে। ও যখন পছন্দ করছে না, আমি আর কোনো ছেলের সাথে মিশবো না।
এর দুই সপ্তাহ পর ঈদ। একদিন হঠাৎ একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটলো। বাসা থেকে ডাক পেলাম। বাবা খবর পাঠিয়েছেন, ঈদটা যাতে এবার বাসাতে করি।
আমার আনন্দের সীমা ছিলো না। ঈদের আগেই আমরা বাড়ি চলে গেলাম। গিয়ে শুনলাম, আমরা চলে আসার পর থেকেই মা ভীষণ অসুস্থ। তার জন্যই বাবা ঈদে আমাদের বাড়ি আসতে বলেছেন।
ঈদটা খুব ভালো কাটলো। আমার কাজিন ভাই-বোন, যাদের সাথে অনেকদিন দেখা নাই, খুব ভালো সময় কাটলো তাদের সাথে। আমরা অনেকক্ষণ আড্ডা দিলাম। শান্ত আমাদের সাথেই ছিলো কিছুক্ষণ, তারপর কই জানি চলে গেলো।
সেই রাতে আমি শ্বশুড়বাড়িতে ছিলাম। পুরো সন্ধ্যা শান্ত বাড়ি ফেরেনি। ও ফিরলো গভীর রাতে। চোখ ওর লাল, যেন নেশা করে এসেছে। ঘরে ঢুকেই প্রচন্ড জোরে আমাকে চড় মেরে কুৎসিত একটা গালি দিয়ে বললো, 'তোর কতো ছেলে লাগে?'
আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। শান্ত এমন একটা কথা বলতে পারলো? সত্যিই পারলো?
শান্ত থামলো না। চিৎকার করতে করতে বললো, 'যেখানেই যাস, ছেলেদের সাথে ঢলাঢলি করা শুরু করস। কেন? কেন? এতো ক্ষিদা কেন তোর? আমারে দিয়ে চলে না?'
আমি রেগে গিয়ে বললাম, 'এসব কি বলছো তুমি? তোমার মুখ সামলাও।'
শান্ত আরো জোরে একটা চড় মেরে বললো, 'মামাতো খালাতো ভাইদের সাথে এতো ঢলাঢলি কেন তোর? মনে করছোস কিছু বুঝি না আমি? এতো লাগে কেন তোর? এতো লাগে কেন?'
আমার চোখে পানি চলে এলো। আমার কাজিনরা আমার আপন ভাইয়ের মতো। তাদের নিয়ে এতো কুৎসিত কথা ও কিভাবে বললো? আমি প্রতিবাদ করলাম। প্রতিবাদটুকু করা উচিত হয়নি। সে রাতে আমার ওপর নরক নেমে এলো। আমাকে ও যেভাবে পেটালো, কোন পুলিশও চোরকে ওভাবে পেটায় না।
ওটাই শেষ। তার পরদিন আমি বাসায় চলে গেলাম। ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিলাম। বাবা ওর নামে মামলা করলো। ওর সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেলো আমার।‌
তবুও ও অনেক চেষ্টা করেছিলো আবার আমাকে পেতে। ফোন দিতো। বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো। রাস্তায় কোথাও গেলে পিছু নিতো। কিন্তু তবুও ওর সাথে একটাও কথা বলি নাই আমি।
এরমধ্যেই আমার বিয়ে ঠিক হলো। আমার মামাতো ভাইয়ের এক বন্ধু আমাকে পছন্দ করেছিলেন। আমার এতসব ঘটনা জানার পরও তিনি আমাকে বিয়ে করতে চান। আমি রাজি হলাম। কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ে।
বিয়ের দুদিন আগে শুনলাম, শান্ত সুই*সাইড করেছে।
ওর জন্য খুব খারাপ লেগেছিলো তখন। কিন্তু আর কিছুই করার ছিলো না।
বিয়ের দিন, সকালে রেডি হচ্ছি, হঠাৎ খবর পেলাম, বিয়েটা হবে না। আমার হবু বর মারা গেছে। সকালে নাকি রুমে ঢুকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে তাকে।
আমি প্রচন্ড একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম। সেই ধাক্কা সামলে উঠতে আমার সময় লেগেছিলো।
বাসায় থাকাটাও আমার জন্য কষ্টকর হয়ে গিয়েছিলো। আমার পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার পর থেকে বাবার সাথে সম্পর্ক আর স্বাভাবিক হয় নাই। তিনি আমাকে উটকো বোঝা মনে করতেন। আমি তাই আবার ঢাকায় ফিরে এলাম। এক বান্ধবীর সাহায্যে মেয়েদের একটা মেসে উঠলাম। তখন হাতে টাকা পয়সা নাই, একটা চাকরির খুব দরকার। সেই যে প্রথম যে স্কুলটায় চাকরি করতাম, সেখানে অপু নামের একটা ছেলে ছিলো না? ওর সাথে যোগাযোগ করলাম। ও আবার স্কুলে চাকরির ব্যবস্থা করে দিলো।
আমার দিন ভালোই কাটছিলো। অপু আর আমি খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলাম। একদিন ও বললো, 'দিপ্তি, আমাকে বিয়ে করবে?'
আমার যে কি ভালো লাগলো শুনে। আমি সাথে সাথে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা সেদিন অনেকক্ষণ ঘুরলাম, অনেকক্ষণ। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো, বাসায় ফিরছি দুজন একসাথে, হঠাৎ অপু বললো, 'এই দেখো। আমার মনে হচ্ছে কেউ আমাদের ফলো করছে।'
আমি দেখলাম, সত্যিই তাই। অন্ধকার গলিতে কেউ একজন অনেকক্ষণ আমাদের পিছে পিছে আসছে। আমরা যেখানেই যাই, সেখানেই ও যাচ্ছে। অপু ভীষণ রেগে গিয়েছিলো। বললো, 'দাঁড়াও, শালাকে একটা শিক্ষা দিয়ে আসি।' বলেই ও ছুটে গেলো ওর দিকে। কিন্তু কেমন একটা ভয় লাগা মুখ নিয়ে ফিরে এলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'কি হয়েছে?' অপু বললো, 'আমার চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে গেলো।'
অদ্ভুত লাগলো কথাটা শুনতে। জিজ্ঞেস করলাম, 'কেমন ছিলো লোকটা দেখতে?' অপু বললো, 'একদম সাধারণ মানুষের মতোই। কিন্তু ডান চোখের ভ্রুটা একটু কাটা। আর গলার কাছে একটা দাগ।'
আমি শুনে যে কেমন ভয় পেয়েছিলাম, বোঝাতে পারবো না। শান্তর ডান চোখের ভ্রু একটু কাটা ছিলো। আর ও আত্ম*হত্যা করেছিলো গলায় ফাঁস দিয়ে।
সেদিন হোস্টেলে ফিরে আমার কেমন ভয় ভয় লাগছিলো। আমার যে রুমমেট, সে কিছুদিনের জন্য বাড়ি গেছে। রুমে আমি একা। লাইট জ্বালিয়ে ঘুমিয়েছিলাম, মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে দেখলাম লাইট অফ। কে অফ করেছে, জানি না। পানির পিপাসা পেয়েছে‌। টেবিলের ওপর আমার পানির বোতল। ওদিকে হাত বাড়িয়েছি, হঠাৎ দেখলাম ,অন্ধকারে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে।
ভয়ে আমার সারা শরীর হিম হয়ে গেলো। যে দাঁড়িয়ে আছে, সে আমার সামনে এসে ফিসফিস করে বললো, 'বলেছি না, অন্য ছেলের সাথে ঢলাঢলি না করতে। তুই সারাজীবন আমার ছিলি, এখনও আমারই থাকবি। তোকে আর কারো হতে দিবো না।'
বলেই সে উধাও হয়ে গেলো। আমি সারারাত বিছানায় বসে থাকলাম। ঘুম এলো না আমার।
পরদিন অপুকে ব্যাপারটা বললাম। সে আমাকে নিয়ে তার পরিচিত এক হুজুরের কাছে গেলেন। হুজুর একটা তাবিজ দিলেন আমাদের। বললেন, ভয় নেই।
সেদিনও আমি আর অপু সন্ধ্যা পর্যন্ত একসাথে ছিলাম, সেই জিনিসটা আসে কিনা দেখার জন্য। সেটা এলো না। বুঝলাম তাবিজে কাজ হয়েছে। তবুও আমি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারছিলাম না। এরপর আরো তিন সন্ধ্যা আমি অপুর সাথে ঘুরলাম। একবারও ওর দেখা পেলাম না। রাতেও সে আমার কাছে এলো না।
আমি যে কি ভীষণ নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম, তুমি চিন্তা করতে পারবে না। অপুকে বললাম, 'চলো, আজকেই আমরা বিয়ে করি।' অপু রাজি হয়ে গেলো। আমরা সেদিনই বিয়ে করলাম। অপুও মেসে থাকতো, ওর মেসমেটরা ওর ঘরটাই আমাদের জন্য সাজিয়ে দিলো। আমাদের বাসর ঘর। আমরা সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া করে রাতে মেসে ফিরলাম। ওর বন্ধুরা আমাদের রেখে চলে গেলো।
আমি বিছানায় বসে আছি, অপু আমাকে রেখে বাথরুমে গেছে। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে, সে বাথরুম থেকে ফিরছে না। আমার কেমন একটু লাগলো, আমি গিয়ে বাথরুমের দরজায় ধাক্কা দিলাম। দেখলাম, দরজা খোলা। লাইট বন্ধ। ভেতরে অপু মেঝেতে পড়ে আছে। ওর মুখটা বাথরুমের ভেন্টিলেটরের দিকে। চোখটা খোলা। মুখে ভীষণ আতংকের ছাপ। কি দেখে যেন প্রচন্ড ভয় পেয়েছে।
আমি ভেন্টিলেটরের দিকে তাকালাম। ওখানে একটা মুখ। মুখটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে, ভয়ংকর ভাবে হাসছে। মুখটা আমার ভীষণ চেনা।‌ শান্তর মুখ।'
দিপ্তি আপা থামলেন। বাইরে তখন বৃষ্টি থেমেছে। আমাদের উঠে পড়া উচিত। আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'অপু কি বেঁচে ছিলেন?'
'হ্যাঁ। কিন্তু আর দেখা হয়নি আমাদের। আমরা সেদিনই আলাদা হয়ে যাই।'
'আর কখনো কারো সাথে সম্পর্ক করেননি?'
'না। আর সাহস হয়নি করার।'
'শান্তকে আর কখনো দেখেছেন?'
'না, দেখিনি। কিন্তু আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, যখন বাসায় একা থাকি, কিংবা একলা অন্ধকারে কোন গলি দিয়ে যাই, কে যেন আমাকে অনুসরণ করে। কিন্তু কাউকেই আমি দেখতে পাই না।'
আমরা বাড়ি যাবার জন্য উঠলাম। আমি একটু মজা করেই জিজ্ঞেস করলাম, 'এই যে আপনার সাথে এতোক্ষণ বসে গল্প করেছি, আমার কিছু হবে না তো?'
আপা ভীষণ চমকে উঠলেন, যেন এই কথাটা তিনি একবারও ভাবেননি। ভয় পাওয়া গলায় আমাকে বললেন, 'তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাও। খবরদার কোথাও দাঁড়াবে না, পিছনে তাকাবে না। অন্ধকার কোনো গলি দিয়েও পার হবে না‌। এক্ষুণি বাড়ি চলে যাও, এক্ষুণি।' বলে তিনি এক মুহুর্তও না দাঁড়িয়ে হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন বাসস্ট্যান্ডের দিকে।
আমি মুচকি হেসে বাড়ির পথ ধরলাম। পথে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বাদাম খেলাম। আমার বাসায় যেতে একটা অন্ধকার গলি পাড় হতে হয়। সেখানেও নিশ্চিন্ত মনে ঢুকে পড়লাম। আপার বলা কাহিনী আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারিনি। আমার মনে হচ্ছিলো, তিনি প্রচন্ড ডিলিউশনে ভুগছেন।
সেদিন গলিটা একদম জনমানবশূন্য, নীরব, নিস্তব্ধ ছিলো। বৃষ্টি দেখে কেউ তেমন বেরোয়নি রাস্তায়। গলির ভেতরে স্ট্রিটল্যাম্পটা কয়েকদিন ধরে নষ্ট বলে গলিটাও অন্ধকার। আমি মোবাইলে টর্চ জ্বেলে গলিটা পার হচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে হলো, আমার পেছন পেছন কে যেন আসছে।
আমি মোবাইলের টর্চটা পেছনে ধরলাম। কাউকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু কেমন একটা ভয় ভয় অনুভূতি আমার মনটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিলো। আমি আবার হাঁটতে শুরু করলাম। এবার একটু দ্রুত। হঠাৎ মনে হলো, আমার পেছনে যে আসছিলো, সে আবার আমাকে অনুসরণ করছে। আমার সাথে সাথে তার পায়ে হাঁটার গতিও বেড়ে গেছে।
আমি দাঁড়ালাম। পেছনে ফিরতে সাহস হচ্ছিলো না। তবুও মনের সব সাহস এক করে পেছনে আবার আমার মোবাইলের টর্চটা ধরলাম। ভেবেছিলাম এবারও কাউকে দেখবো না। কিন্তু প্রচন্ড প্রচন্ড একটা ভয় নিয়ে দেখলাম, গলির মাথায় একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু বুঝতে পারলাম, সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
আমি দৌড়াতে শুরু করলাম। খুব জোরে দৌড়। এক দৌড়ে পৌঁছে গেলায় বাড়ি। বাসায় এসে হাঁফাতে লাগলাম। আম্মু অবাক হয়ে বললো, 'কিরে, এমন দৌঁড়ায় বাড়ি আসলি কেন?' আমি আম্মুর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলাম না। ফ্যালফ্যাল কলে আম্মুর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
এর কিছুদিন পর আমার আরেক জায়গায় চাকরি হয়ে গেলো। আমি সেখানে চলে গেলাম‌। আগের স্কুলে যে কয়দিন ছিলাম, দিপ্তি আপার সাথে এই বিষয়ে কোনো কথা হয়নি। আমি তাকে এড়িয়ে চলতাম। তিনিও হয়তো বুঝতেন, আমি কেন তাকে এড়িয়ে চলছি। কখনো তাই আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি।
আপা সত্যিই কাউকে দেখতে পেতেন, নাকি সবটাই তার মনের অলীক কল্পনা, আমি জানি না। আমি কাউকে দেখতে পেয়েছিলাম, না আপার গল্পের জেরে আমার মন কাউকে কল্পনা করে নিয়েছিলো, তাও জানি না। শুধু একটা ব্যাপার বুঝতে পেরেছিলাম। জীবনের কোনো ডিসিশনই হুটহাট নিতে হয় না। তাড়াহুড়ো করে কোনো ভুল ডিসিশন তার খেসারত দিতে হয় আজীবন, দিপ্তি আপাদের মতো। তখন আর আমাদের কিছু করার থাকে না, যতোই সাহায্য করতে চাই না কেন। প্রচন্ড অসহায় হয়ে যেতে হয় আমাদের।
(শেষ)
গল্প- রক্ষণশীল
লেখা- সোয়েব বাশার

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন