মিতু চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় বসে বাইরে তাকিয়ে আছে। আজ শুক্রবার। অফিস বন্ধ। ছুটিরদিন প্রতি সপ্তাহে সন্ধ্যার পর মিতু এভাবেই কৌশিককে সাথে নিয়ে বারান্দায় বসে গল্প করে সময় কাটায়।
আজ এক বিশেষ কারণে মিতুর মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। তাই কৌশিককে না ডেকেই আজ সে একাএকা বারান্দায় এসে বসেছে।
হঠাৎ পিছন দিক থেকে কৌশিক এসে মিতুর ঘাড়ের কাছে ভারী নিশ্বাস ফেলে বলল,
" জানো মিতু! তুমি হচ্ছো আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে যোগ্য মেয়ে।"
মিতু তীক্ষ্ণ চোখে ঘাড় ঘুরিয়ে কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বলল,
কৌশিক আমতা আমতা করতে করতে বলল,
" না মানে, অফিসে তুমি বেস্ট ইমপ্লোয়ী, মেয়ের স্কুলে তুমি বেস্ট মম। আমার কাছে শ্রেষ্ঠ স্ত্রী। আমি প্রতিদিন নতুন করে তোমার প্রেমে পড়ি। তোমার যোগ্যতায় মুগ্ধ হই। অথচ...!"
খুব ঝাঁঝ নিয়েই মিতু বলল,
" অথচ কি? তোমার মায়ের দৃষ্টিতে আমি অথর্ব মহিলা। তোমার বোনের দৃষ্টিতে আমি অহংকারী মেয়ে মানুষ। তোমার ভাইয়ের দৃষ্টিতে, তোমার মতো বিড়াল স্বামীর স্ত্রী হওয়ায় আমি এবাড়িতে খেতে পেরেছি, অন্য কোনো পুরুষের স্ত্রীর হলে আমার স্বামীর ভাত কপালে জুটতো না, এই তো বলবে!"
কিছুক্ষণ আগে নিচে যাওয়ার সময় সিঁড়ির পাশে যেতেই মায়ের রুম থেকে কিছু কথা মিতুর কানে এসেছে। এর পর থেকেই সে রেগে আছে।
কৌশিক মাথা নিচু করে মিনমিন করতে করতে বলল,
" কে বলছে তোমাকে এসব? বোকা মেয়ে! মা তোমাকে ভীষণ পছন্দ করেন। কেয়াও তোমাকে যথেষ্ট মূল্যায়ন করে।"
" আমি সব জানি কৌশিক। কেন তোমার মা আমাকে পছন্দ করবেন না! তোমার চার ভাইয়ের বউদের মধ্যে শিক্ষায়, সৌন্দর্যে, যোগ্যতায় আমিই সেরা। আর কেয়া! আমাদের কাউকেই পছন্দ করে না।"
"অবশ্যই তুমি যোগ্য। কিন্তু বলছিলাম কি! অফিস থেকে ফিরে নিজের রুমে সময় না কাটিয়ে একটু মায়ের সাথে বসলেও তো পার। ভাবীদের সাথে রান্নাঘরে থাকতে পার। কাজ করার দরকার নেই। তুমি একটু গেলেই ওরা খুশি হবে। প্রয়োজনে সায়মাকে একজন শিক্ষক দিয়ে দাও।"
" আমি রান্নাঘরে যাই না তোমাকে কে বলছে?"
" কেউ বলেনি। আমারই মনে হলো আমার মিষ্টি বউটা সব জায়গার মতো ঘরেও সেরা বউ হওয়ার যোগ্যতা রাখে। যদি তুমি একটু...।
মিতু দৃঢ়কণ্ঠে বলল,
" না কৌশিক। আমি সেরা বউ হতে চাই না। সবচেয়ে বড় কথা বউরা কখনো সেরা হয় না। তোমার বড় ভাবী, ছোট ভাবী চব্বিশ ঘণ্টা তোমাদের পরিবারে শ্রম দিয়ে, সেবা দিয়ে তোমাদের পরিবারের পাশে থেকে আজ বড় ভাবী অসুস্থ। ছোট ভাবীর ছেলে পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল করে, মায়ের কেয়ারের অভাবে। কই তোমরা তো ভাবীদের সেরা বউ বলো না! মায়ের কথা বাদই দিলাম, তুমিও তো কখনো বলোনি।"
" তুমি জানো না, ওরা ভীষণ দুষ্ট।".
" আমি সব জানি কৌশিক বউরা দুষ্টই হয়। যারা শ্বশুর পরিবারে কাজ করতে করতে নিজের জীবন, যৌবন, ক্যারিয়ার, সন্তানের ভবিষ্যৎ সব ক্ষয় করে ফেলে, দিন শেষ তাদের কপালে দুষ্ট অপবাধই জোটে।"
" তুমি ভুল বুঝছ মিতু! "
" আমি ঠিকই বুঝছি কৌশিক। আমি তোমার ভাবীদের মতো অত বোকা নই, সংসারে কাজ করে মেকি প্রশংসার জন্য নিজের শরীর হারাব। আমার অত স্বস্তা প্রশংসার দরকার নেই।"
কৌশিক অসহায়ের মতো করে বলল,
" মিতু!"
" কী মিতু! তোমাদের সংসারে কাজের দরকার এই তো! সাবুর মাকে বলে দেব তার মেয়ে রিনাকে নিয়ে আসতে, সে এখন থেকে এখানেই থাকবে চব্বিশঘণ্টা। তার বেতনভাতাও সব আমি পরিশোধ করব। তারপরও আমার কাছে এসব অন্যায় আবদার নিয়ে আসবে না।"
মিতুর অগ্নিমুর্তি দেখে কৌশিক আর কথা বাড়াল না।
মিতুর বিয়ে হয়েছে আজ আটবছর। বিয়ের আগেই সে একটা বেসরকারি ব্যংকে চাকরি করত। ব্যাংকের চাকরি মানেই ব্যস্ততা। ব্যস্তাতার অজুহাতে মিতু এই আট বছরে একদিনের জন্যও রান্নাঘরে যেতে পারেনি।
কৌশিকদের যৌথ পরিবার। ওরা চার ভাইয়ের মধ্যে কৌশিক হচ্ছে তিন নাম্বার। ছোট ভাই ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে। চাকরিতে ঢুকলেই বিয়েটা সেরে ফেলবে। মেয়েটা অনেক ধূর্ত। রোজ নিয়ম করে এ বাড়িতে আসে। মায়ের সাথে গল্প করে। মায়ের চুল বেঁধে দেয়। বাড়ির সবাই তাদের সম্পর্কের কথা জানে।
তার আসল টার্গেট হয়েছে মা। ইতিমধ্যে তার কাজে সে সফল হয়েছে। মা উঠতে বসতে সারাক্ষণই স্মৃতির কথাই বলে।
" স্মৃতির মতো মেয়ে বউ হিসাবে পাওয়া যে কোনো পরিবারের জন্য সৌভাগ্য। এত সুন্দরী মেয়ে। অথচ গুরুজনের প্রতি কেমন শ্রদ্ধা। অথচ একটা চাকরি করলেই কিছু মেয়ের অহংকারে পা মাটিতে পড়ে না।"
এসব কথা মা মিতুকে ইঙ্গিত করে কৌশিককে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেন।
কৌশিকের ভীষণ রাগ হয়। স্মৃতির কী এমন যৌগ্যতা! বিশ্ববিদ্যালয় পড়লে কী হবে? তার রেজাল্ট ভালো নয়। অথচ তার বউ মিতু ইউনিভার্সিটির টপার ছিল। কত বড় চাকরি করে। প্রায় লাখ টাকা বেতন পায়। বাইরে তার কত সম্মান। অথচ স্মৃতি মায়ের পাশে একটু বসেই মায়ের কত প্রশংসা পাচ্ছে।
কৌশিক মরিয়া হয়ে পড়ে বাইরের মতো ঘরেও নিজের স্ত্রীকে যোগ্য দেখতে। তার মনে হয় স্মৃতির মতো মিতুও যদি মায়ের পাশে একটু বসে তাহলে হয়তো মা মিতুরও প্রশংসা করবে।
রাতেরবেলা মিতু কৌশিকের সাথে একটাও বাড়তি কথা বলেনি। মেয়েকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে মেয়ের পাশেই ঘুমিয়ে পড়ল। কৌশিক বারবার দরজার পাশ থেকে ঘুরে চলে এলো। স্ত্রীকে ডাকার সাহস পায়নি। মিতুর সকালবেলা অফিস আছে। হঠাৎ ঘুম ভাঙলে মিতুর মাথা ব্যথা করবে। ঠিকমতো অফিসে কাজ করতে পারবে না। অথচ ব্যাংকের চাকরিতে সারাক্ষণই অফিসে ব্যক্তিগত কষ্ট ভুলে গিয়ে কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে হয়।
মিতু অফিস থেকে ফিরে কাঁধ থেকে ব্যাগটা সোফার উপর ছুঁড়ে ফেলে সটান হয়ে খাটে শুয়ে পড়ল। প্রতিদিনের মতো আজও কৌশিক এসে মিতুর মাথার নিচে একটা বালিশ দিয়ে পা'টা বাঁকা করে খাটের উপর তুলে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে মিতুর নাক ডাকার শব্দ শুনতে পাওয়া গেল।
মিতুর নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে কৌশিকের মনে হলো গতকাল সে মিতুর কাছে অন্যায় আবদার করে ফেলেনি তো।
মেয়েটা সারাদিন অফিসে কত পরিশ্রম করে। বাসায় আসলে মেয়েকে পড়ায়। কৌশিকের ব্যক্তিগত আবদার মেটায়। সে কখনো স্বামী সন্তানের প্রতি অবহেলা করেনি। সাবুর মায়ের বেতন পাঁচহাজার টাকা মিতুই দেয়। সংসারে কাজ করতে পারবে না, সেকারণে বিয়ের সময় বাবার বাড়ি থেকে সে সাবুর মাকে নিয়ে এসেছে।
অথচ মেয়েকে সে এখনো কোনো শিক্ষক দেয়নি। যদি শিক্ষক তার মতো যত্ন করে না পড়ায় এটাই তার ভয়।
বিয়ের পর আজ পর্যন্ত সে কৌশিককে কারো বানানো চা পান করায়নি। কৌশিকের চা'টা পর্যন্ত সে বানিয়ে ফ্লাক্সে রেখে যায়। কৌশিক একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেেজি পড়ায়। তাকে বেশিক্ষণ অফিসে থাকতে হয় না। আড়াইটার মধ্যেই সে বাসায় চলে আসে।
মিতু ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেও কথাগুলো কিন্তু মিথ্যা নয়। এই পরিবারের কাজের জন্য বড়ভাবী, ছোট ভাবী কখনো নিজেদের ব্যক্তিগত সুখের কথা ভাবেনি। সারাক্ষণ বাবা-মায়ের সেবা করেছে। রান্নাঘরে কাজ করেছে। অথচ বাচ্চাগুলো শিক্ষকের কাছে কী পড়েছে না পড়েছে মা হিসাবে কখনো দেখার সুযোগ পায়নি। এখন ছেলেটা পরীক্ষায় ফলাফল খারাপ করেছে। প্রিন্সিপ্যাল স্যার প্যারেন্টস মিটিং ডেকেছেন। ছোট ভাবীকে উপস্থিত থেকে কৈফিয়ত দিতে হবে। কেন ছেলে খারাপ ফলাফল করেছে!
এতএত কষ্ট ভাবীরা পরিবারের জন্য করেও দিন শেষ তাদের কাঁধে কেবল বদনামটুকুই জোটে।
বিয়ের সময় তো মা মিতুকেও অনেক পছন্দ করে বিয়ে করে এনেছেন। এখন মিতু খারাপ হয়ে গেলো। মিতু না হয় কাজ না করার কারণে খারাপ হলো। মা তো বড় ভাবী, ছোট ভাবীকেও বিন্দু পরিমান পছন্দ করেন না। আচ্ছা বিয়ের পর কি সবাই স্মৃতির সাথেও এমনই আচরণ করবে? এখন যার বন্দনা করছে, বিয়ের পর তারই বদনাম করবে।
ঘুম থেকে উঠে মিতু দেখে দুই হাতে দুকাপ ধুমায়িত কফি নিয়ে হাসিমুখে সামনে দাঁড়িয়ে আছে কৌশিক। অন্যদিন হলে মিতু অবাক হতো। এবং সঙ্গে সঙ্গে সে বিস্ময়টা প্রকাশও করত। কারণ বিয়ের এত বছর পর মিতুর আগে অফিস থেকে ফিরেও কখনো কৌশিক একাজটা করেনি। আজই প্রথম সে মিতুর জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে এলেো।
অথচ গতকাল সন্ধ্যার পর থেকেই মিতু অকারণে বিরক্ত হয়ে আছে সব কিছুর উপর। তাই এই রূপে কৌশিককে দেখেও সে স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
" এককাজ কর মেয়ের জন্য একজন ভালো শিক্ষক ঠিক কর। তোমার পরিচিত কোনো ছাত্র হলেও চলবে।"
"হঠাৎ মেয়ের জন্য শিক্ষক কেন?"
" আমাকে ভালো বউ হতে হবে না! মেয়েকে পড়াতে বসালে রান্নাঘরে সময় দেবো কীভাবে?"
" দুঃখিত মিতু। দরকার হলে মেয়ের জন্য শিক্ষক রাখব। কিন্তু তোমাকে ভালো বউ হতে হবে না। তুমি এমনিতেই অনেক ভালো বউ।"
" কেন তোমাদের পরিবারে তো রোজ নিয়ম করে হাঁড়ি না বসালে চুলায়, আর যত যোগ্যতায় থাক সব চাপা পড়ে যায়। সে অথর্ব বউ হিসাবে প্রমাণীত হয়।"
" মিতু অহেতুক তুমি রাগ করছ। বাদ দাও এসব।"
" ভুল করেছ কৌশিক তুমি। একটা অর্ধশিক্ষিত মেয়েকে বিয়ে করলেই পারতে, যে মজা করে চা বানিয়ে ভালো বউয়ের খেতাব পেয়ে যেত। ইউনিভার্সিটির টপাররা তো অথর্বই আর অহংকারীই হবে।"
কৌশিক বুঝতে পেরেছে কথা বললে এখন বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। গতকাল কৌশিকের কথায় মিতু ভীষণ কষ্ট পেয়েছে। সে নিজের রোজগারের টাকাকে কখনো নিজের টাকা মনে করেনি। মায়ের চোখের অপারেশনটা সে নিজের টাকায় করিয়ে দিয়েছে। বাবা-মার রুমে এসি কিনে দিয়েছে। কারেন্টবিল, গ্যাসবিল প্রতিমাসে মিতুই পরিশোধ করে। কারণ সংসারে সময় দিতে পারে না। সেকারনে সে যেটা শ্রম দিয়ে পারে না, সেটা অর্থ দিয়ে হলেও করে দেয়। অথচ ইদানিং মা স্মৃতির গুণগান গেয়ে যাচ্ছে। যেটা যেকোনোভাবে হোক মিতুর কানে গেছে।
মিতুর কথা হয়তো সত্য শ্বশুর বাড়ির দৃষ্টিতে বউরা কখনো সেরা হয় না। কাজ করলে যদি সেরা হওয়া যেত তাহলে বড় ভাবী, ছোট ভাবী হতো। অর্থ দিয়ে যদি সেরা হতো তাহলে মিতু হতো। কই মাতো কাউকেই পছন্দ করছেন না।
কৌশিক উঠে গিয়ে মিতুর কাঁধে হাত রাখল।
" চলো মিতু আজ ডিনারটা আমরা বাইরেই করব। রেডি হয়ে নাও। "
মিতু রেডি হতে হতে বিড়বিড় করে বলল,
" তুমি আমাকে বুঝতে পেরেছ কৌশিক সেটাই বড় কথা। আমি ভালো স্ত্রী হতে চাই, ভালো বউ নয়।
#ভালো বউ
কামরুন নাহার মিশু
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন