বৃহস্পতিবার, মে ১৬

জমানো কিছু অভিযোগ

 #জমানো_কিছু_অভিযোগ

(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________
(১ম অংশ)
আমি তিতলী। ২০০৮ সালে ক্লাস এইটে পড়াকালীন সময়ে আমার বিয়ে হয়। বিয়েটা পারিবারিকভাবেই হয়েছিল। আমার স্বামীর সঙ্গে আমার বয়সের পার্থক্য ছিল ১৮ বছরের। ছোটো বেলা থেকেই সুখ কী জিনিস তা সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করার ভাগ্য আমার হয়ে ওঠেনি। হয়তো পরিস্থিতি নয়তো বয়সের অপরিপক্বতার জন্যই আরো বেশি বুঝতে পারিনি। একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিতেও কার্পণ্য বোধ করিনি।
শুনতে খারাপ লাগলেও একটা অপ্রিয় সত্য হচ্ছে, আমি কখনোই অবহেলা ব্যতীত বাবার ভালোবাসা পাইনি। আমার জন্মও তার মুখে হাসি ফোটাতে পারিনি। এ কথা কী করে বলছি জানেন? আমরা ১ ভাই ২ বোন হলেও বর্তমানে শুধু দু'বোন-ই আমরা। বড়ো ভাই মা'রা যায় ছোটো থাকতেই। বাবা হতাশ হোন। দ্বিতীয়বার সন্তান নেন ছেলের আশায়। জন্ম হয় তখন আমার আপু মিতালির। এরপর আর বাবা কোনো বাচ্চা নিতে চায়নি। তবে আল্লাহর পরিকল্পনা যে ছিল অন্যকিছু। আর তাই তো আপু হওয়ার ৬ বছর পর আমার জন্ম হয়। জন্মের এক মাস পার হওয়ার পরও তিনি ঢাকা থেকে বাড়িতে আমাকে দেখতে আসেননি।
বাবার এহেন আচরণে মা কষ্ট পেতেন। আক্ষেপ করে কেঁদে কেঁদে আমাকে সব বলতেন। আমি সব শুনেও চুপ থাকতাম। কী-ই বলতাম আমি? জোর করে আর যাই হোক, ভালোবাসাটা তো আর পাওয়া যায় না। আমিও পাইনি। বাবার অবহেলা, অযত্নই ছিল আমার ছোট্ট জীবনের কষ্ট পাওয়ার অন্যতম কারণ।
মায়ের কাছ থেকেই জানতে পারি, আমার ছ'বছর বয়সে পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসি। ঢাকায় গিয়ে আপুর বিয়েটাও হয়ে যায়। বাবা অবশ্য আমাদের খুব একটা ভালো না বাসলেও তার ইচ্ছে ছিল আমাদের দু'বোনকে অনেক পড়াশোনা করাবে। সেটা আর হয়ে ওঠেনি। দুলাভাই ছিল মায়ের মামাতো বোনের ছেলে। তাই বাবা রাজি না থাকা সত্ত্বেও মায়ের জন্য আপুর বিয়েটা তখন হয়ে যায়।
ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত ঢাকায় পড়ার পর বাবার বদলি হয় গাজীপুরে। এখানে এসে ভর্তি হই ক্লাস সিক্সে। নতুন ক্লাস, নতুন জায়গা, নতুন বন্ধু-বান্ধব সব মিলিয়ে আমার জীবন ও সময়টা নতুন করে বেশ ভালোই কাটছিল। এভাবে একটা বছর পার হওয়ার পর জীবনের মোড় পাল্টে যায় আমার।
২০০৭ সাল। ক্লাস সেভেনে ওঠার পর আমি স্কুলে যাওয়ার পথে লক্ষ্য করলাম একটা ছেলে প্রায়ই আমার দিকে তাকিয়ে থাকত। সাথে আরও কয়েকজন ছেলেও থাকত। বিষয়টা আমার ভালো লাগত না। ভয় করত ভীষণ।
১৪ই ফেব্রুয়ারি ২০০৭
সেদিন প্রথম ছেলেটার সাথে আমার কথা হয়। স্কুলে যাওয়ার পথে পিছু ডেকেছিল,'তিতলী! দাঁড়াও।'
আমি ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সে সামনে এসে একটা ডায়েরী এবং একটা গোলাপ দিয়ে বলল,'তুমি এগুলো নিলে আমি খুব খুশি হব।'
ভয় পেলেও আমি বলে ফেললাম,'এটা কী?'
'আমার মনের কথাগুলো ডায়েরীতে লেখা আছে। তোমার ভালো লাগলে তুমি পড়িও নয়তো ছিঁড়ে ফেলে দিও।'
'আপনি আমার নাম জানলেন কী করে?'
'আমি সব জানি। তোমার বাবা কী করেন, তোমরা কোথায় ছিলে আগে, কয় ভাই-বোন সব। তুমি প্লিজ ডায়েরীটা নাও।'
আমি চুপ করে রইলাম। খুব অস্বস্তি লাগছিল আমার। আবার স্কুলেও দেরি হয়ে যাচ্ছিল। এক সময় ডায়েরীটা নেওয়ার জন্য ও খুব তাড়া দেয়। আমিও ডায়েরীটা ব্যাগে ভরে স্কুলে চলে যাই। রাতে পড়তে বসার সময় আমি ডায়েরীটা খুলি। প্রতিটি পাতায় শুধু একটা কথাই লেখা ছিল,'জাস্ট ফর ইউ।' আমি একটু অবাকই হলাম। পাতাগুলো উল্টাতে উল্টাতে একটা পাতায় কিছু লেখা দেখতে পেলাম। সেখানে লেখা ছিল,'তিতলী তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে। আর ভালোলাগা থেকেই তো ভালোবাসা। প্লিজ! তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিও না। প্রথম যেদিন তোমাকে দেখি তারপর থেকে একটা মুহূর্তও তোমাকে ভুলতে পারিনি। সবসময় শুধু তোমার কথাই মনে পড়ে।'
তার আবেগ মাখানো এরকম নানান ধরণের কথা আমার মনকে কোমল করে তোলে। আমি অভিভূত হই। সেদিন আপুও আমাদের বাসায় ছিল। আপুকে ভীষণ ভয় পেতাম বিধায় রিস্ক নিতে চাইনি। ডায়েরীটা ছিঁড়ে বারান্দা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলাম। পরেরদিন আবার একই জায়গায় দেখা হয়। এতকিছুর মধ্যে তো নামটাই বলা হলো না। ওর নাম আকাশ। সেদিনও আকাশ আমাকে একটা চিঠি দেয়। আমি ভয়ে ভয়ে বলি,'প্লিজ! আমাকে এগুলো দেবেন না। বাড়ির কেউ জানতে পারলে আমার সমস্যা হবে।'
আকাশ বলেছিল,'তুমি শুধু বলো, তুমি আমাকে ভালোবাসো। বাকি সব আমি সামলে নেব। তোমার কোনো সমস্যা হতে দেবো না।'
'এটা হয় না।' বলে আমি স্কুলে চলে যাই। কোনো রকমে ক্লাসে মনোযোগ দিয়েও বারবার এসব কথাবার্তাই আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। স্কুল থেকে ফেরার পথে একটা ছোট্ট মেয়ে আমার হাতে একটি কাগজ দিয়ে বলল,'আপু এই কাগজটা নাও।'
'কে দিয়েছে?' জিজ্ঞেস করলাম আমি।
'আকাশ ভাইয়া।'
মেয়েটা চলে গেল। আমি চিঠিটা নিয়ে বাড়িতে চলে আসি। রুমে পড়ার সাহস হয়নি। বাথরুমে গিয়ে চিঠির ভাঁজ খুলি। চিঠিতে এতটাই আবেগ মেশানো ছিল যে, যেকোনো পাষাণ, নিষ্ঠুর হৃদয়ের মানুষেরও মন গলে যাবে। এভাবে আরো কিছু সময় চলে যায়। আমি আস্তে আস্তে তার সম্পর্কে জানতে পারি। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে আকাশ। এস.এস.সি পরীক্ষায় ফেইল করে পড়াশোনা আর করেনি। আর্থিক অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। তবে হ্যাঁ, ও ভালো ছবি আঁকতে পারত। তারচেয়েও বড়ো কথা আকাশ আমায় প্রচণ্ড ভালোবাসতো। হয়তো ওর এই ভালোবাসাই আমাকে ওর প্রতি দুর্বল করে ফেলেছিল। আমাদের নিয়মিত কথা না হলেও দেখা হতো। তবে সেটা দূর থেকে। মাঝেমাঝে আমাকে ২/৩ দিন পরপর চিঠিও দিত।
একদিন আমার মা আর বোন সব জানতে পেরে যায়। প্রচণ্ড বিশ্রি ভাষায় আমায় গালি-গালাজ করে। সারারাত ঘুম হয়নি আমার। কী করব না করব কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না। ভোর চারটা নাগাদ আমি আকাশের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখতে বসি,'আমার বাড়িতে সম্পর্কের কথা জেনে গেছে। কেউ মেনে নেবে না এই সম্পর্ক। আপনি আমাকে প্লিজ ভুলে যান।'
আকাশ মানতে নারাজ। সে কিছুতেই আমায় ভুলতে পারবে না। কান্নাকাটি করে বারবার আমাকে বোঝাতে লাগল। তিনটা বছর সময় চাইল আমার কাছে। আমিও তো ভালোবাসতাম, তাই ছেড়ে যেতে পারিনি। আবারও আমাদের সম্পর্ক চলতে থাকে। তবে এবার আর সরাসরি কখনো দেখা করিনি, কথা বলিনি। যোগাযোগ হতো চিঠির মাধ্যমে। আকাশ দূর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে আমায় দেখত যাতে কেউ কখনো বুঝতে না পারে আমাদের মধ্যে এখনো সম্পর্ক আছে।
২০০৮ সাল।
আকাশের সাথে আমার সম্পর্কের এক বছর। এর মাঝে নানান রকম ঝামেলা হয়েছে। মা আবার জানতেও পেরেছিল সম্পর্কের কথা। বকাবকিও করেছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে সে'বার বাবাও জানতে পেরে যান। মাকে আড়ালে নিয়ে বলেছেন, আমার খাবারে যেন বিষ মিশিয়ে দেয়। রাগে বলুক বা জিদ্দে কথাটা জানার পর ভীষণ ভেঙে পড়েছিলাম!
২০০৮ সালের মার্চ মাসের শেষেরদিকে; একদিন মা এসে বলল,'চল ভাইয়ের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসি।'
আমি জানতে চাইলাম,'এই সময়ে কেন?'
'এমনিই। অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয় না তো। তাই ভালো লাগছে না।'
আমি রাজি হই। মায়ের সাথে ঢাকায় তার মামাতো ভাইয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাই। সেখানে বেশ কয়েকটা পাত্রপক্ষ এসে আমায় দেখেও গিয়েছে। বাবা রাজি না থাকায় বিয়ের কথা আর আগায়নি। তিনদিন পর আমি আবার গাজীপুর চলে আসি। আমার একটু সন্দেহও লাগে তখন। মা কি এজন্যই আমায় ঢাকায় নিয়ে গেছিল?
১লা মে, ২০০৮
বুয়াকে নিয়ে সকাল সকাল মা বাড়ি-ঘর সবকিছু পরিষ্কার করছিল। কৌতুহলবশত আমি জিজ্ঞেস করলাম,'হঠাৎ সবকিছু পরিষ্কার করছ যে?'
মা বলল,'বাড়িতে মেহমান আসবে।'
'কারা আসবে?'
'ঐদিন যে গেলাম ভাইয়ের বাসায়। ওরা আসবে। তুই সুন্দর দেখে একটা থ্রি-পিস পর।'
আমি উত্তরে কিছুই বলিনি। যথাসময়ে মেহমান এলো। তবে সাথে অপরিচিত মেহমানও ছিল। যাদের আমি চিনি না। কখনো দেখিওনি। সাথে মামা-মামিও এসেছিল। মামির ছোটো বোন আমার কাছে এসে বলল শাড়ি পরতে। আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম,'কেন?'
'তোমাকে আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন দেখতে এসেছে।'
আমি বিস্ময় নিয়ে কিছুক্ষণ নিষ্পলক শুধু তাকিয়েই রইলাম। এক সময় মনে মনে নিজেকে আশ্বস্ত করলাম,'দেখলেই তো আর বিয়ে হয়ে যায় না।'
তারা আমাকে দেখে চলে যাওয়ার সময় ছবি তুলেও নিয়ে গেল। এসব ঘটনা আমি আকাশকেও জানাই। আকাশ চিন্তিত হলেও আমায় বলেছিল, এই বিয়ে ঠিক হলেও সে হতে দেবে না। সবসময় সে আমার সাথে আছে। এরপর একদিন মা আমাকে ডেকে বোঝালেন,'আকাশের সঙ্গে তোর বিয়ে হলে কখনো ভালো থাকতে পারবি না। ও তোর যোগ্য নয়। তোকে কখনো সুখে রাখতে পারবে না। ছোটো থেকেই তো তুই কত কষ্ট করেছিস। আমি চাই বিয়ের পর তুই আরামে, সুখে-শান্তিতে জীবন কাটিয়ে দে।'
কথাটা তো সত্যিই। আকাশের সুন্দর একটা মন ছাড়া আর কিছুই নেই। মায়ের কথায় কেমন যেন আমিও কিছুটা বদলে যেতে লাগলাম। পরীক্ষার বাহানা দিয়ে আকাশকে নিজের ব্যস্ততা দেখাতে লাগলাম। আকাশ মেনে নেয়।
পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ১৫ দিন স্কুল বন্ধ দেয়। এই সময়ে মা আবার ঢাকা যায়। সেই পাত্রপক্ষরা নাকি আবার আসবে। সবাই নানান রকম কথা বলে আমার সামনে হাসাহাসি করছিল। আর আমার বারবার শুধু আকাশের কথাই মনে পড়ছিল।
ছেলের সাথে আমার কথা হয়। সে জানতে চেয়েছিল,আমি এই বিয়েতে রাজি নাকি। ভয়ে সত্যি কথাটি বলতে পারিনি। বারবার চেয়েও মুখ দিয়ে আমার একটা কথাও বের হয়নি। আন্টি পাশ থেকে বারবার চিমটি দিয়ে ইশারা করে, আমি যেন 'না' বলি। আমি তবুও চুপ করেই থাকি। তখন আন্টি নিজেই বলল,'না, না। ওর কারও সাথে কোনো সম্পর্ক নেই।'
এরপর আমার বিয়ে তার সাথেই ঠিক হয়। আকাশ এই কথা জানার পর মায়ের কাছে এসেছিল। মায়ের পা ধরে কান্নাকাটি করে বারবার আমায় ভিক্ষা চেয়েছিল। তার চোখের পানিতে আমার মায়ের মন গলেনি। অপরদিকে আমি ছিলাম নিরুপায়। পরিবারের মুখের ওপর একটা কথাও বলার সাহস ছিল না আমার। খালি হাতেই সেদিন আকাশকে ফিরে যেতে হয়েছিল।
অবশেষে মায়ের ইচ্ছে মতোই টাকাওয়ালা ছেলের সাথে আমার বিয়ে হয়। বিয়েতে শশুরবাড়ি থেকে আমাকে সাত ভরি গহনা দেয়। বিয়ের দুই বছর না যেতেই স্বামী তার ঋণ শোধ করতে বিক্রি করে দেয় গয়নাগুলো। মোটামুটিভাবে সব পেলেও শান্তিটা আমি ঠিক পাচ্ছিলাম না। পরবর্তীতে সে ব্যবসা-বাণিজ্য করে লাখ লাখ টাকা ইনকাম করেছে। আমাকে কখনো এক আনাও দেয়নি। যদি কখনো আমি এই প্রসঙ্গ তুলেছি তো তার কাছে শুনতে হয়েছিল,'আমার জিনিস আমি যা ইচ্ছে তাই করেনি। ঐসব না পরলে কী হয়?'
সংসারে ঝামেলা হবে বিধায় আমিও আর তেমন কিছু বলতাম না। নিজে টিউশনি করিয়ে নিজের শখ-আহ্লাদ পূরণ করতাম। আমার কোনো শখ পূরণ কিংবা ভালোমন্দ খাওয়ানোর, পরানোর মন-মানসিকতা তার কখনোই ছিল না। তার শুধু টাকার প্রতি মায়াই ছিল। শুধু আফসোস হয় মায়ের জন্যই। যেই উদ্দেশ্যে সে আমাকে এখানে বিয়ে দিয়েছিলেন; না সেই ইচ্ছে পূরণ হয়েছে, আর না আমি সুখে আছি!
বিয়ের এক বছর এক মাস পর আমি কনসিভ করি। কোল আলো করে আমার ঘরে আমার মেয়ে আসে। ২০১৭ সালে মা মা'রা গেল। তার ছয় মাসের মাথায়ই বাবা নতুন করে আবার বিয়ে করলেন। সেই ঘরে একটা মেয়েও হয়। বাবার বাড়ি-ঘর, সম্পত্তি সব লিখে দেন নতুন বউ এবং মেয়ের নামে। নিজের স্বামীর দৃষ্টিতে এজন্য আমার জায়গা আরো নিচে নেমে যায়। কখনো তার কাছে কিছু চাইলে সে আমায় মুখের ওপর বলে দিত,
'তোমাকে কিছু দিয়ে লাভ হবে না। মানুষ শ্বশুরবাড়ি থেকে কতকিছু পায়। তুমি তো কয়দিন গিয়ে থাকতেও পারো না।'
খুব কষ্ট লাগে যখন এসব কথা শুনি। অতীতের কষ্টের কথা স্মরণ করলে তখন মনে হয়, কেন বেঁচে আছি আমি? টাকাই সব? আমার স্বামীর সাথে সম্পর্কটা কীরূপ জিজ্ঞেস করলেও হয়তো আমার বলার মতো কিছু থাকবে না। তার কোনো কিছুতেই আমি ইনভলভ্ নেই। আমি শুধু তার সংসার করি আর খাই। এছাড়া আর কোনো কিছুতেই আমার কোনো মূল্য নেই। সংসার জীবন আমার এভাবেই চলছে। বাবাও ফোন দিয়ে কখনো খোঁজ-খবর নেয় না। আসলে কি জানেন, মানুষের জীবনটা যে কখন কীভাবে বদলে যায় তা পরিস্থিতির শিকার না হলে কখনো বোঝা যায় না। মাঝে মাঝে তো ভাবি, নিঃস্বার্থ ভালোবাসার মূল্য কোথাও নেই। তখন যদি পরিবারের কথা না ভেবে একটু সাহস করে আকাশের হাত ধরতাম, তাহলে হয়তো ভালো থাকতে পারতাম। আকাশের অনেক টাকা-পয়সা না থাকলেও সুন্দর মন ছিল। ভালোবাসত আমায়। বাবা-মায়ের সম্মান দেখতে গিয়ে আজ আমি নিজেই নিজের কাছে পরাজিত।
(২য় অংশ)
তিতলী তার কথাগুলো শেষ করে থামল। হাত-ঘড়িতে একবার সময়টা দেখে নিয়ে বলল,'আজ তাহলে উঠি। বাচ্চাদের মাদ্রাসা থেকে আনতে হবে। আর হ্যাঁ, পারলে আমার জীবন কাহিনিটা গল্পের পাতায় রূপ দিয়েন। খুশি হব।'
আমি মুখে কিছুই বললাম না। শুধু ঘাড় নাড়িয়ে স্মিত হেসে সায় দিলাম। তিতলী চলে যাওয়ার পরও আমি যেরকমভাবে বসে ছিলাম। ঠিক সেভাবেই কতক্ষণ বসে রইলাম। এর মাঝেই ঝুমঝুম করে বৃষ্টি শুরু হয়। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে বিশাল বড়ো থাই গ্লাসটার সামনে দাঁড়াই। মুহূর্তেই গ্লাসটিতে অজস্র বৃষ্টির ফোঁটা জরো হয়েছে। ভেতর থেকে বাইরের দিকটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। সবকিছু ঝাপসা দেখাচ্ছে। কেন জানি আমার বুকের ভেতর থেকেও একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। আমি থাই গ্লাসের ওপর আঙুল দিয়ে আনমনেই লিখলাম,'Money can buy everything but money can't buy mentally peace.'
'কী লিখছ আপু?'
প্রশ্ন শুনে আমি পিছু ফিরে তাকালাম। আমার কাজিন নীলি দাঁড়িয়ে আছে। ওর হাতে দু'মগ কফি। দু'দিন হয়েছে আমার কাছে বেড়াতে এসেছে। ওর চোখেমুখে এখনো কৌতুহল। বৃষ্টির পানিগুলো এলোমেলো হয়ে লেখাগুলোও মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি খেয়াল করলাম নীলি এখনো সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। ভ্রুঁ উঁচু করে জানতে চাইলাম,'কী?'
নীলি বলল,'কী লিখেছিলে?'
আমি মৃদু হাসলাম। কাচের ওপর ডান হাত রেখে লেখাগুলো মুছে বললাম,'জমানো কিছু অভিযোগ।'
(সমাপ্ত)
____________
বিঃদ্র-১ঃ ১ম অংশটুকু সম্পূর্ণ সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা। লেখাগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে লিখতে কিছু কথা, কিছু বাক্য যোজন-বিয়োজন করতে হয়েছে। যেগুলো অপ্রয়োজনীয় বাক্যালাপ মনে হয়েছিল সেগুলো আমি লিখিনি। এই ঘটনাটি গত বছর এক আপু আমার কাছে শেয়ার করে অনুরোধ করেছিল, আমি যেন গল্পটা লিখি। কিছুটা শিক্ষনীয় মনে হওয়ায় আমিও রাজি হয়েছিলাম। তবে নানান রকম ব্যস্ততায় লেখা হয়ে ওঠেনি। আপুটা প্রায়ই মনে করিয়ে দিত। লজ্জা পেতাম আমি। অবশেষে সময় সুযোগ বের করে লিখেই ফেললাম। অনেকের কাছেই মনে হতে পারে, ঘটনা তো আহামরি কিছু নয় বরং প্রতি ঘরে ঘরে এইসব কাহিনি হয় তাহলে কেন লিখলেন? আমার উত্তর হবে, ঠিক এই কারণেই লিখেছি। বাবা-মায়েরা যদি সন্তানের মনের কথাগুলো শুনত তাহলে হয়তো জীবনটা অন্য রকম হলেও হতে পারত।
২য় অংশটা গল্পটিকে সুন্দর একটা রূপ দেওয়ার জন্যই লিখেছি। অর্থাৎ এতটুকু কাল্পনিক।
বিঃদ্র-২ঃ অনেক সিনিয়র সিনিয়র ভাইয়া, আপুরা আমার লেখা পড়ে থাকেন। যদি এই গল্পটিও আপনারা পড়ে থাকেন, তাহলে এতটুকুই রিকোয়েস্ট করব ভবিষ্যৎ-এ আপনার সন্তানদের মনের কথাগুলোও একটু বোঝার চেষ্টা করবেন। কী হবে এত টাকা খুঁজে? টাকা কি শেষ পর্যন্ত সত্যিই সুখ দিতে পারে?
বিবাহিত ভাইয়া কিংবা ভবিষ্যৎ- বিয়ে করবে এমন তরুণদের উদ্দেশ্যে বলব, একটা মেয়ে সবকিছু ছেড়েছুড়ে আপনার কাছে এসেছে। টাকার সুখ সবকিছু নয়। একটু সময়, একটু ভালোবাসা একটু ভালো ব্যবহার তার সাথে তো করতেই পারেন। নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে পারে এমন মেয়েরা শুধু এইটুকুতেই খুশি থাকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন