#ফিরে_দেখা
#অনুগল্প
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
ক্লাস চলাকালীন ফোন বেজে উঠায় স্যার বেশ রেগে যান আমার ওপর। সচারচর এই সময়ে আমায় কেউ ফোন করে না। স্যার ধমকে উঠে বললেন,'ফোন বাজে কার?'
আমি থমথমে মুখে স্যারকে স্যরি বলে ফোন বের করলাম, সাইলেন্ট করার জন্য। তখন দ্বিতীয়বারের মতো আবারও ফোনটা বেজে উঠল। নাম্বার দেখে বুকের ভেতরটায় কেমন যেন করে উঠল আমার। এটা আমার জন্য অপ্রত্যাশিত কল-ই ছিল। আমি স্যারকে বললাম,'স্যার জরুরী কল। বাইরে গিয়ে কথা বলে আসি?'
স্যার অত্যন্ত বিরক্তের সাথে বলল,'যাও।'
আমি মেয়েদের কমন রুমে এসে ফোন ব্যাক করলাম। ওপাশ থেকে সেই সুপরিচিত কণ্ঠস্বরটি ভেসে এলো আর আমি মনে হচ্ছিল দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছিলাম।
ওপাশ থেকে সাজিদ বলল,'কেমন আছো?'
আমি তৎক্ষণাৎ কিছু বলতে পারলাম না। চুপ করে রইলাম। সে আবার বলল,'শুনতে পাচ্ছ?'
আমি ছোট্ট করে বললাম,'হু।'
'আমি তোমার কলেজের নিচে আছি। বাইরে আসো তো।'
আরেক দফা অবাক হওয়ার পালা আমার। আজ থেকে প্রায় পাঁচ মাস আগে আমি সাজিদের সঙ্গে দেখা করতে ঢাকায় গিয়েছিলাম। অনেক অনুরোধ করেছিলাম একটাবার দেখা করার জন্য। একটা সময়ে সে রাজিও হয়েছিল কিন্তু দেখা আর হয়নি। তার কাজের চাপ ছিল সত্যিই। আমি পাগলামি তখনও কমাইনি। প্রচণ্ড কাজের চাপ, তার ওপর আমার এমন পাগলামিতে সাজিদ বিরক্ত হয়ে ওঠে। কিছুটা রাগারাগিও করেছিল ম্যাসেজে। তার ঐ ম্যাসেজটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে আমার দু'চোখ বেয়ে পানি পড়েছিল। এরপর আমি আর কখনও তার জন্য কাঁদিনি। ঐটাই ছিল তার জন্য আমার প্রথম এবং শেষ কান্না। পরবর্তীতে সে আমায় অনেকবার স্যরিও বলেছিল। কিন্তু আমি সেদিন থেকেই গুটিয়ে গিয়েছিলাম। পরে দেখা করবে বলেছিল। আমি এর উত্তরে কিছুই বলিনি। আর আজ পাঁচ মাস পর তার ফ্রি সময় হলো। এই পাঁচ মাসে তার সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ হয়নি।
'তাড়াতাড়ি আসো। আমি ফোন রাখছি।' সাজিদের কথায় আমার ধ্যান ভাঙল। বোরকার ওপর কলেজ ইউনিফর্মের এপ্রোন পরা ছিলাম। এপ্রোনটা খুলে আয়নায় দেখে নিলাম আমার চোখে আজ কোনো অশ্রু এসেছে কীনা! নিকাব দিয়েই চোখ দুটো কচলে নিচে নামলাম আমি। কলেজ গেইটের বাইরে গিয়ে সাজিদকে দেখতে পাই। আমায় দেখতে পেয়েই সে সুন্দর করে হাসল। জিজ্ঞেস করল,'ভালো আছো?'
আমি মাথা নাড়িয়ে বোঝালাম ভালো আছি। সাজিদ বলল,'এতদিন রাগ করে ছিলে তাই না? কী করব বলো? কাজের যে প্রচুর চাপ ছিল। তুমি কি এখনও আমার ওপর রাগ করে আছো?'
'না।'
'আচ্ছা চলো কোথাও গিয়ে বসি।'
'পারব না। আমার ক্লাস আছে।'
'তাহলে আমি কোথাও অপেক্ষা করি? তুমি ক্লাস শেষ করে এসো।'
'অপেক্ষা? না,অপেক্ষাও করতে হবে না।হঠাৎ আপনি কী মনে করে এলেন?'
'আমি বলেছিলাম না, আমিই এসে দেখা করব? কোথায় দেখা করব জিজ্ঞেস করায় বলেছিলে তোমার কলেজের সামনে যেন আসি। তাই সারপ্রাইজ দিতে চলে আসলাম।'
আমি মৃদু হাসলাম। যদিও মুখ ঢাকা থাকায় সাজিদ আমার হাসিটা দেখতে পায়নি। আমি বললাম,'সারপ্রাইজ তো আমি সেদিন হয়েছিলাম, যেদিন একটাবার অল্পকিছু সময়ের জন্য দেখা করতে চেয়েও খালি হাতে আমায় ফিরে আসতে হয়েছিল। আমি বিশ্বাস করি, আপনার কাজের অনেক চাপ ছিল। কিন্তু কি জানেন, প্রায়োরিটি সময়ের ওপর নয় গুরুত্বর ওপর নির্ভর করে। আমি আপনার কাছে মূল্যহীন এবং গুরুত্বহীন দুটোই ছিলাম। তবে আমি অবাক এবং খুশিও হয়েছি আপনি এসেছেন বলে। তবে সেদিন যেই কথাটা বলতে চেয়েছিলাম আজ আর তার প্রয়োজন হবে না।'
'ও হ্যাঁ, তুমি কিছু বলতে চেয়েছিলে। আমি ভুলে গিয়েছিলাম একদম। কী কথা বলতে চেয়েছিলে?'
'ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তেমন কিছুই নয়। সেসব কথা তুলেও লাভ নেই।'
'কী হয়েছে বলবে তো।'
'বিয়ে হয়ে গেছে আমার।'
'মানে? মজা করছ?'
'মজা নয়। সত্যি। সেদিন ঢাকা থেকে ফিরে আসার পর তিনদিনের দিন আমার বিয়ে হয়ে গেছে। এ কথাগুলো বলতেই আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। বলতে চেয়েছিলাম, আমি তো আপনাকে ভালোবাসি। কিন্তু আপনার কাজের এতই ব্যস্ততা ছিল যে পাঁচটা মিনিট সময়ও আপনি আমায় দিতে পারেননি। আর আজ সেই পাঁচ মিনিটের সময় হলো পাঁচ মাস পর। আপনি ব্যস্ত থাকেন, আমি চেয়েছিলাম সরাসরি কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। কিছু বিষয় থাকে যেগুলো সামনা-সামনি বলতে হয়। কিন্তু আপনার তো আমার সাথে ফোনে কথা বলারও সময় হয়নি কখনও।'
সাজিদ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাকিয়ে আছে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে। আমি ব্যস্ততা দেখিয়ে বললাম,'যাই আমি। ক্লাস আছে। ভালো থাকবেন। ভবিষ্যতের জন্য অনেক বেশি শুভকামনা রইল।'
আমি ফিরে এলাম কলেজে। পিছু ফিরে তাকাইওনি আর। সাজিদ কী করছিল তখন? সেও উল্টোপথে হাঁটা ধরেছিল নাকি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে অপলকভাবে তাকিয়ে থেকে আমার চলে আসা দেখছিল? সে কি কষ্ট পেয়েছিল? আমি জানতাম, আমার প্রতি তার আলাদা টান, সফ্ট কর্ণার এবং ফিলিংস ছিল। সে আমায় বলেওছিল আমায় সে পছন্দ করে। আমি জানিনা, এই পছন্দ শুধু পছন্দই ছিল নাকি ভালোবাসা বলতেও কিছু ছিল। সে যা হোক, আমার যে আর পিছু ফিরে তাকানোর উপায় নেই....
(সমাপ্ত)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন