মঙ্গলবার, মে ১৪

বৌদির বোন পর্ব 13

 


সংসারের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয় ইন্দ্রাণী।দিদি আর তার সন্তানের জন্যও সে যথাসাধ্য চেষ্টা করে। আত্মীয়স্বজন সবাই চলে গেছে।সুখের সংসারে ঘনিয়ে ওঠা একচিলতে কালো মেঘ আস্তে আস্তে সারাটা আকাশ ঢেকে দিতে লাগল।দিদি নিজের জন্য নিজে ঘরেই রান্নার ব্যবস্থা করল।  সবার সাথে কথাবার্তা বন্ধ করে দিল।ছোট্ট ছেলেটাকে কাউকে ছুঁতে দেয় না। অদ্ভুত এক দমবন্ধ পরিস্থিতি তৈরি হল।কোনো রাস্তা না পেয়ে অগত্যা তার বাবাকে খবর দেওয়া হল। বাবা এসে অনেক বোঝালো।কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না।  আসলে পরাজয়ের কাঁটা বিঁধে আছে চন্দ্রানীর বুকে।এতো সহজে ভোলার নয়। পরাজয় কেউ চট করে ভোলে না।নিজের স্বামীর উপর বিশ্বাসটাও টলে গেছে তার। বাবা তাকে কদিনের জন্য বাড়ি নিয়ে যেতে চাইল।চন্দ্রানী তাতেও রাজী না।  দমবন্ধ সেই পরিস্থিতির মধ্যেই দিন কাটতে লাগল। 

 

 

 

বিয়ের পর অষ্টমঙ্গলাতে বাড়ি যাবার ব্যাপারটাও কোনো রকমে সাঙ্গ  হল।সবকিছু গুছিয়ে কাজের বৌকে বুঝিয়ে দিয়ে ইন্দ্রাণী অর্ককে নিয়ে গেল ঠিকইকিন্তু দিনেই ফিরে এল। অর্কর জীবনের ছন্দেও তাল কাটল। সারাদিন কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকে ইন্দ্রাণী। 

আর রাতে বিছানায় শুয়ে চোখের জল ফেলে। অর্ক অনেক বোঝায়।কিন্তু ইন্দ্রাণীর প্রতি মুহূর্তে নিজেকে অপরাধী মনে হয়। 

ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পেতে চাওয়াতে অপরাধ নেই।

 কিন্তু যে পথে সে প্রাপ্য অর্জন করেছে সেটা ভেবেই নিজেকে অপরাধী লাগে। 

কি করবে ভেবে পায় না। দিদির গর্ব ছিল স্বামীকে নিয়ে। 

যে অপমান করছিল তার উত্তর তো ইন্দ্রাণী দিতেই পারত। 

মোবাইল দেখিয়ে বলতে পারত---"দেখএই তোর বর!"  কিন্তু সে তা করেনি।দিদির ঘর ভাঙার ইচ্ছে তার ছিল না।

শুধু তার বরকে কব্জা করে নিজের উদ্দেশ্য সাধন করতে চেয়েছিল। একটা জেদ ছিল হয়তো।কিন্তু সেটা সাময়িক।  অর্ককেও সব বলতে পারে না। 

কথায় কথায় অর্ককে বলে---"জানোদাদার জন্য খুব কষ্ট হয়। বেচারার কি দোষ বলতো?  একটা কিছু করতে হবে।

-----"কি করবে তুমি?" 

-----"তুমি যদি ভুল না বোঝ একটা চেষ্টা করতে পারি।

-----"তোমাকে ভুল বোঝার প্রশ্নই নেই।

-----"ঠিক আছে বাবার সাথেও কথা বলে দেখি।

 

 

পরদিন রাতে বাবাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে গিয়ে তার পরিকল্পনার কথা সব বলে। 

বাবা বলে----"আমার দিক থেকে কোনো সমস্যা হবে নারে মা। তোকে আমি  চিনি। তবে তোকে আবার কোনো সমস্যাতে পড়তে হোক সেটা চাইনা রে।"

 ------"আর তো কোনো রাস্তা দেখছি না বাবা ওদের দুজনকে মিলিয়ে দেবার। আমার জন্য ভেবনা। দেখি যদি কিছু হয়। ছেলেটার কথাও তো ভাবতে হবে।

বাবা আর আপত্তি করে না। ইন্দ্রাণী দিদির গতিবিধির উপর লক্ষ্য রাখে। রাতে সবাই যখন যে যার ঘরে যাবে ঠিক সেই সময় ইন্দ্রাণী দাদাকে বলে

----"তোমার সাথে জরুরি কিছু কথা ছিল।"  

কথাগুলো এমন সময় এমন ভাবে বলে যাতে দিদি শুনতে পায়।  

দাদা বলে---"বল।

------"আগে বাবাকে ঘুম পাড়িয়ে দেই। তারপর আসছি।"----বলেই সে তাড়াতাড়ি বাবার ঘরে চলে যায়।বাবাকে ঘুম পাড়িয়ে ঘরে গিয়ে অর্ককে বলে দাদার ঘরের দিকে যায়।

লক্ষ্য করে দিদির ঘরের দরজা ভেজানোভিতরে আলো জ্বলছে।যাতে তার টের পেতে অসুবিধে না হয় তাই দাদার দরজার সামনে বেশ জোরেই বলে----"আসব দাদা?" 

------"আয়।"  

ইন্দ্রাণী ঘরে ঢোকে। বড় আলো নিভিয়ে নাইট ল্যাম্প জ্বেলে দেয়। 

দরজাটা ভেজিয়ে দেয়। ------"কি করছিস?" 

------"সাবধানের মার নেই দাদা। যা চলছে বাড়িতে।

ইন্দ্রাণী দাদার পাশে বসে। মুখ নীচু করে থাকে। কিছু বলে না। আসলে সে কান পেতে বোঝার চেষ্টা করে দিদির গতিবিধি।

দরজা খোলার হালকা আওয়াজ কানে আসে। দাদা বলে----"কি বলবি বল।" ------"এভাবে কতদিন চলবে দাদাএকটা কিছু তো করতে হয়।

------"কি করব বল?" 

------"তুমি একটু শক্ত হও। জীবনটা তো ছেলেখেলা নয়।

------"কিন্তু আমার কোনো কথা শুনলে তো। কি এমন হয়েছে তুই  বাড়ির বৌ হওয়াতে তাই তো বুঝতে পারছি না।

------"আর ওর বরকে তো আমি কেড়ে নেইনি। তাহলেও নয় কথা ছিল। তুমি সরাসরি কথা বলো দাদা। একটা সমাধানে তো আসতে হবে।  তোমার ভাই বলছিল যদি দিদি কোনোভাবেই রাস্তায় না আসে তাহলে সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলাই ভাল।

------"ভেবেছি আমিও। ছেলেটা আছে যে।

------"ছেলেকে নিজের কাছে রেখে দাও। আমি আছি তো। ছেলের বা তোমার কোনো কষ্ট হতে দেব না।" –

-----"তুই আর কত করবি?" 

-----"করতে তো আমাকে হবেই। আমার জন্যই তো  অবস্থা।

 নিজেকে খুব অপরাধী লাগে।

--- বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে ইন্দ্রাণী। দাদা তার মাথায় হাত রাখে। ইন্দ্রাণী তার বুকে মাথা গুঁজে কাঁদতে থাকে। 

দাদা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে----"তোর তো কোনো দোষ নেই। কেন শুধু শুধু কষ্ট পাচ্ছিস?"

 

 

 

 

 ঠিক সেই সময় দড়াম করে দরজা খুলে গেল। যেন ভয় পেয়ে ইন্দ্রাণী আরো শক্ত করে দাদাকে জড়িয়ে ধরল। ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকে চন্দ্রানী চেঁচিয়ে উঠল -----"মাঝরাতে এখানে ছিনালি হচ্ছে?  লজ্জাশরম বলতে আর কিছু  রইল না।

-----"কি বলছ তুমি?  মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার।"-

--দাদা পাল্টা চেঁচিয়ে উঠল। 

------"তাতো বলবেই। অন্যের বৌকে বুকে নিয়ে আদর করতে তো ভালোই লাগে। বললে মাথাখারাপ না?" 

-----"কি অসভ্যের মতো কথা বলছ?" 

-----"আমি অসভ্য

আর তোমরা সভ্যমাঝরাতে সভ্যতা দেখাচ্ছ এভাবে

আমি কিছু বুঝিনাশুনিনি যেন কিছু?" 

-----"শুনবে না কেনআড়িপাতার স্বভাব তো। গোয়েন্দাগিরি করছে

লজ্জা করে না?" 

-----"কেন করবেনষ্টামি করতে পারতাতে লজ্জা নেই।

অর্ক সব শুনতে পায়। মনে মনে ভাবে বাবার ঘুম না ভেঙে যায়। 

ইন্দ্রাণী ভাল করতে গিয়ে আরও খারাপ করে ফেলল নাতো

একবার মনে হয় গিয়ে  ইন্দ্রাণীকে ঘরে নিয়ে আসে। তারপর ভাবে শেষ অবধি অপেক্ষা করা উচিত।

 ইন্দ্রাণীর উপর তার ভরসা আছে।

 

 

ওদিকে তর্কাতর্কি চলতেই থাকে। চন্দ্রানী আরো ক্ষেপে ওঠে। 

এবারে তার লক্ষ্য নিজের বোন। 

বলে----"মরতে পারিস না মুখপুড়ি?  কালসাপ একটা ঢুকেছে সংসারে। নিজের বর ছেড়ে মাঝরাতে অন্যের ঘরে ঢলাঢলি করছিস। একজনে হচ্ছে না

ওকেও চাই বুঝি?" 

ইন্দ্রাণী আর সহ্য করতে পারে না। 

বলে ওঠে------ "চাইলে অনেক আগেই তোর কপালে শণি নাচত।

-----"তবে রে। আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।

চন্দ্রানী তেড়ে গিয়ে ইন্দ্রাণীর চুলের মুঠি ধরে কিলচড় মারতে শুরু করে।

 দাদা তাকে ছাড়িয়ে ধাক্কা মেরে বিছানায় ফেলে দেয়। 

ফুঁসে উঠে বলে----"অনেক হয়েছে। তোমার জীবনে যার জায়গা নেই তাকে নিয়ে কোনো কথা বলার অধিকার তোমার নেই।

 ডিভোর্সের জন্য রেডি হও। সকালেই সব ব্যবস্থা করছি।

দাদার এমন উগ্র মূর্তি ইন্দ্রাণীর মনে ভয় ধরায়। 

সে বলে----"দাদা শান্ত হও প্লিজ। তুমি এমন করলে  বেচারা কোথায় যাবে

ছেলেটার কথাও তো ভাবতে হবে।

-----"তোর অত ভাবার দরকার নেই। 

আর কখনো আমাদের মধ্যে আসবি না।"

--- বলেই চন্দ্রানী বরের হাত ধরে বলে---"ঘরে চল। আর এখানে নয়।থাকে?" 

------"এমন তো তোমার আগে মনে হয়নি। এখনো বুঝতে পারছ না  কালনাগিনী তোমার মাথা খাচ্ছে?" 

------"কেউ মাথা খায়নি। ওর মন অনেক বড়। যদি নিজেকে শুধরে নিতে পারওকে নিজের বোনের মর্যাদা দিতে পার তো বোলো। 

নইলে আমার সিদ্ধান্ত পাকা। এবার যাও।

------"না যাব না। তুমি আগে চল।

------"ক্ষমা চেয়ে নাও ওর কাছে।

ইন্দ্রাণী তাড়াতাড়ি বলে ওঠে----" বড়।  কেন ক্ষমা চাইবে।

 আমি কথা দিচ্ছি আর কখনো তোমাদের মধ্যে থাকব না। 

আমার আগে  সংসার দিদির। ওর কথা সবার আগে। 

 

আমি ছোট বোন হয়েই থাকব। দিদিতুই শুধু  বাড়ির একজন সদস্য হিসেবে আমাকে মেনে নে। দেখবি সবাই একসাথে ভালো থাকব আমরা। ঘরে যাও দাদা।

দিদি তার হাত ধরে ঘরে নিয়ে যায়। ইন্দ্রাণী ঘরে এসে ধপাস করে বিছানায় পড়ে। অর্ক অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন