বৃহস্পতিবার, মে ১৬

জোৎস্না কাব্য

 "জোৎস্না কাব্য"

ছোট গল্প
#প্রীতিলতা চক্রবর্তী

নীরার চোখ হঠাৎ আটকে যায় রাস্তার পাশের ফুচকার দোকানটাতে। তার প্রাক্তন স্বামী এক মেয়েকে নিয়ে ফুচকা খাচ্ছে। একটি প্লেটে ফুচকা নিয়ে তার স্বামী খুব সযত্নে মেয়েটিকে খাইয়ে দিচ্ছে।মেয়েটি কিছু একটা হাত নেড়ে নেড়ে বলছে আর তুহিন অর্থাৎ নীরার প্রাক্তন স্বামী হেসে কুটি কুটি হচ্ছে। দৃশ্যটা আপাতঃ দৃষ্টিতে খুব রোমান্টিক হলেও, নীরার চোখ নোনা জলে ভিজে উঠতে লাগলো।

নীরা ধানমন্ডির এই ক্যাফেতে প্রায়ই অফিস শেষে এসে এক মগ কফি নিয়ে বসে ।নিজের সাথে নিজে কিছুটা সময় কাটায়। মন বেশ হালকা লাগে তখন।কিন্তু আজ মনে বাষ্প জমছে। নীরা মেয়েটিকে ভালভাবে দেখবে বলে চেয়ার বদলালো।
তুহিনের পাশে বসা মেয়েটি তুহিনের বর্তমান স্ত্রী। তুহিনের মা বাবাই ছবি পাঠিয়েছিল নীরাকে।দেখতে বেশ সুশ্রী নয়। তবুও তুহিনতো সুখি বর্তমানকে নিয়েই।
নীরা ছিল তুহিনের থেকে আট বছরের ছোট । তুহিনের পাশে বসা নারী তুহিনের সমবয়সী মনে হচ্ছে। কি মুগ্ধতা নিয়ে দুজন দুজনকে দেখছে। নীরা তার ব্যাগ থেকে ছোট আয়নায় নিজেকে দেখে নিল ।এখনও তার সৌন্দর্য একই আছে। নিজের দিকে তাকিয়ে আবার তুহিনের পাশে বসা মেয়েটিকে দেখতেই কেমন বিষন্ন লাগলো নীরার।
নীরা গোলাপী ফর্সা,ছিপছিপে গড়নের ,মাঝারি উচ্চতার মেয়ে। স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটির ছাত্র ও স্যারদের হৃদয়ের কম্পন ছিল সে এক সময়। খুব চুপচাপ শান্ত ভদ্র হওয়ায় চোখের ভাষা বুঝলেও কারও মুখে প্রেম নিবেদনের অভিজ্ঞতা নেই নীরার। এছাড়া নীরার বাবা মা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কোন শিক্ষিত ,ভদ্র স্বচ্ছল ছেলে পেলে নীরার বিয়ে দিয়ে দিবেন। নীরা কখনোই বাবা মায়ের অবাধ্য নয়। তাই অনার্স থার্ড ইয়ারে উঠতেই নীরার বিয়ে হয়ে গেল বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে মাল্টিন্যাশনাল কম্পানিতে জব করা তুহিনের সাথে।
তুহিন যখন নীরাকে প্রথম দেখতে এসেছিল সেইদিনই নীরা নিজেকে প্রশ্ন করেছিল ,"আচ্ছা মানুষ কখন প্রেমে পরে?"নীরা তুহিনের প্রেমে পরেছিল তাঁর ভদ্রতা, গম্ভীর কন্ঠস্বর আর সুঠাম শারীরিক গঠন দেখে। মোট কথা তুহিন ছিল স্বাভাবিকভাবেই প্রেমে পরার মতই ছেলে।
বিয়ের পর নীরা আর তুহিনকে যেই দেখতো সেই বলতো ঈশ্বর নিজ হাতে দুজনের জোড়া মিলিয়েছেন। তুহিন আর নীরা দুজনই ভদ্র। কখনো কোন বিষয়ে তাদের মতের অমিল হয়না। দুই পক্ষের শ্বশুর শ্বাশুড়িও বন্ধু সুলভ। একবছর স্বপ্নের মত কেটে গেল। একদম সহজ সরল সম্পর্ক তুহিন আর নীরার মাঝে।
কিন্তু দেড় বছর পর তুহিন কেমন যেন নির্লিপ্ত হয়ে উঠল। সব সময় কাজে ডুবে থাকতো।অবসর সময় মোবাইল নিয়ে সময় কাটাতো। নীরা আর তুহিন কোন প্রোগ্রামে আত্মীয়দের বাড়ি ছাড়া কোথাও ঘুরতে যেত না। নীরা মন দিয়ে সংসার আর তুহিন কাজ, এভাবেই দিন কাটছিল। দুজনের একান্ত সময় বলতে চার দেয়ালের মাঝে কিছুটা একান্ততা।সেটাও কমে আসতে লাগলো। নীরার কোন কিছুতেই অভিযোগ নেই।আসলে এত ভাল পরিবেশে কারও অভিযোগ থাকেনা।নীরা পড়াশুনা করতে পারছে।সংসারে মা বাবার মত শ্বশুর শ্বাশুড়ি। আর কি লাগে?
দ্বিতীয় বিবাহ বার্ষিকী অনুষ্ঠান শেষে সবাই নীরা আর তুহিনকে সন্তান নেওয়ার প্লান করতে বলল। যখন পুরো পরিবেশ দুষ্টুমীতে ভরে গেল তুহিন সবার মাঝ থেকে উঠে নিজের রুমে চলে গেল। তুহিনের চোখ মুখের ভাষা সবার বোধগম্য হল যে সে খুব বিরক্ত।
নীরা রাতে নিরিবিলি বলল, "তুমি ওভাবে চলে এলে যে। তোমার বেবি পছন্দ নয়? তুহিন কোন কথার উত্তর না দিয়েই শুয়ে পরল।"
পরদিন সকালে খাবার টেবিলে ,নীরার শ্বাশুড়ি বললেন, "নীরার পড়া প্রায় শেষের দিকে,এবারতো নাতী বা নাতনীর মুখ দেখার সুযোগ করে দে বাবা।"
তুহিন কথাটি শোনার পর খাবারের প্লেট ধাক্কা দিয়ে উঠে অফিসে চলে গেল। তুহিনের মা নীরার দিকে তাকিয়ে বলল,
"কি হয়েছে নীরা? তোমরা কি ঝগড়া করেছো?"
নীরা অবাক হয়ে বলল, "মা আমাদের মাঝে তো আজ পর্যন্ত কোন ঝগড়া হয়নি।"
নীরার শ্বশুর নিজের স্ত্রীর তাকিয়ে বিরক্ত নিয়ে বললেন, "তুমিও না।আমাদের বৌমার মত মেয়ে হয়। সে করবে ঝগড়া। মাথা ঠিক আছে তোমার।"
তুহিনের ব্যপারটা কেউ বুঝতে পারল না। সন্ধ্যায় নীরার শ্বশুর শ্বাশুড়ি তুহিনের সাথে বসলেন। তুহিনের কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা জিজ্ঞাসা করায় তুহিন কোন সমস্যা নেই বলে এড়িয়ে গেল।
নীরার বাবা মা তুহিনের বাবা মাকে বুদ্ধি দিলেন ছেলে মেয়েকে ঘুরতে পাঠানোর। বিয়ের পর থেকে নীরা আর তুহিন কোথাও একান্তে ঘুরতে যায় নি। হয়তো এতে তুহিন নীরাকে তার সমস্যা থাকলে বলতে পারে। আর মনটাও ভাল হয়ে যাবে।
নীরাকে নিয়ে তুহিন ঘুরতে রাজি হলো।এক সপ্তাহের ট্যুরে প্রথম কক্সবাজার,এরপর রাঙামাটি ঘুরে সবশেষে গেলো সেন্টমার্টিন। সাগরের তীরে দুজন পাশাপাশি বসে থাকছে ।নীরা পুরো ট্যুরটা খুব এনজয় করলো। প্রিয় মানুষের সাথে ঘুরতে তার স্বর্গের মত লাগছে।কিন্তু পুরোটা সময় তুহিন নির্লিপ্তভাবে আছে। নীরা বুঝতে পারছে না তুহিনের মনে কি চলছে।
সাগরের তীরে বসে নীরা বলল, "শুনছো, কি সুন্দর পরিবেশ তাই না?"
তুহিন মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বলল,"হুম।"
নীরা বলল," তোমার কি কোন কারনে মন খারাপ?"
তুহিন বেশ খানিক সময় নীরার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল। এরপর সাগরের দিকে তাকিয়ে রইল ।কোন উত্তর এলো না।
ঢাকায় ফেরার পর আবার দুজনে দুজনের মত। এদিকে বেশ সময় পেরুলো। নীরার মাস্টার্সও শেষ। আবার সেই সন্তানের চাহিদা সবার মুখে মুখে।
নীরারও চাকরি করার ইচ্ছা নেই। সবাই নীরাকে চাপ দিল সন্তানের ব্যপারে তুহিনকে বোঝাতে।এক রাতে নীরা তুহিনকে বলল,
"শুনছো, আমাদেরতো সন্তান নেবার ব্যাপারে ভাবতে হবে তাই না?"
তুহিন ল্যাপটপ বন্ধ করে বলল," নীরা তোমার কি তাই ইচ্ছা?"
নীরা খুশি হয়ে বলল, "সব মেয়েদেরইতো এই স্বপ্ন থাকে তাই না।"
তুহিন বলল, "নীরা চল আমরা আজ সারারাত হেটে বেড়াই।"
নীরা বলল, "বাবা মা কি ভাববেন!"
তুহিন হেসে শুয়ে পরল। কিন্তু ঘুমালো না।অনেকক্ষন এপাশ ওপাশ করে রাত একটায় উঠে বসল। নীরাও ঘুমায়নি। নীরাকে ডাকতেই নীরা উঠে বসল।
তুহিন নীরার হাত দুটো নিজের হাতে রেখে বলল," নীরা তুমি খুব ভাল মেয়ে। শুধু ভাল নয় অসম্ভব ভাল মেয়ে। কিন্তু আমি তোমার থেকে মুক্তি চাই। বলতে পারো আমি সব কিছু থেকেই মুক্তি চাই।"
নীরা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে নিজেকে সামলে বলল,
"কি হয়েছে আমায় বল। আমি সব সামলে নেব। কি আবোল তাবোল বলছো?"
তুহিন বলল, "কি সামলে নেবে তুমি? তেমন কিছুই হয়নি। আমি জাস্ট সব কিছু থেকে মুক্তি চাই। সংসার ,পরিবার, চাকরি সব কিছু থেকে। আমি জানি তুমি খুব ভালো। আমায় মুক্তি দিবে।"
নীরা ভাঙা গলায় বলল, "তুমি কি অন্য কাউকে ভালবাসো? "
তুহিন বলল, "আমি ভালবাসতে চাই। কিন্তু কয়েকবছর ধরে মনে হচ্ছে আমি একটা রোবট। আমার একই মাত্রায় জীবন চলাকে আমি নিতে পারছি না। আমি দিনে দিনে শেষ হয়ে যাচ্ছি।নীরা আমার এ জীবন ভাল লাগছে না। প্লিজ বোঝ।"
নীরা কি বলবে বুঝতে পারছে না। সকালে দেখা যাবে, বলে নীরা তুহিনকে ঘুম পারালো। সকালে শ্বশুর শাশুড়িকে ব্যাপারটা জানাতেই হিতে বিপরীত হল। তুহিনের বাবা মা তুহিনের উপরই উল্টো রেগে গেল। তুহিনের সব রাগ গিয়ে পড়ল নীরার উপর। তুহিন বাসায় আসাও প্রায় বন্ধ করে দিল।
দুই পক্ষ তুহিন আর নীরার সম্পর্ক নিয়ে তুহিনকে বোঝাল। তুহিন কেবল শুনতো। কোনো প্রতি উত্তর দিত না।নীরাকে এড়িয়ে চলতে থাকায় বড়রা প্রায় জোর করে তুহিন আর নীরাকে বারবার ঘুরতে পাঠাতো। তুহিনকে বেশ বিভ্রান্ত লাগতো। শেষে মনোচিকিৎসক, কাউন্সিলর সব কিছুর শরনাপন্ন হয় তুহিনের পরিবার। পরিশেষে, তুহিন চাকরি ছেড়ে দিল। তৃতীয় পক্ষের যেহেতু কোন অস্তিত্ব নেই নীরা বাসা ছেড়ে নিজের বাবার বাড়িতে গিয়ে দেখল তুহিনের কোন পরিবর্তন আসে কিনা। নাহ তুহিন বেশ অসুস্হ হয়ে পড়তে লাগলো দিন দিন।
শেষমেষ নীরা তুহিনকে ডিভোর্স দিয়ে দিল।নীরা বা অন্য কেউ তুহিনের বিষয়টা বুঝলো না। নীরা একটি বছর ঘোরের মাঝে ছিল। এরপর তুহিনকে ভুলতে চাকরির চেষ্টা করে একটি ব্যাংকে কর্মরত হয়।
তুহিনও এক বছর পর চট্টগ্রাম চাকরি নিয়ে একা থাকা শুরু করে। তুহিনের বাবা মা নীরার সাথে সব সময় যোগাযোগ রাখতো। বোঝাতো সব ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু কিছুই ঠিক হলো না। তুহিন দুই বছর পর তার অফিস কলিগের প্রেমে পড়ল। ও আর আগের তুহিন নেই। খুব হাসি খুশি প্রানোচ্ছ্বল ।অল্প কথায় অট্ট হাসিতে গড়িয়ে পরা, হঠাৎ কোথাও মেয়েটিকে নিয়ে বাইকে লং ড্রাইভে যাওয়া । পার্টি ,কোলাহল প্রিয় এক নতুন মানুষে রূপান্তরিত হল।
তুহিনের বাবা মা যেন নিজের ছেলেকে চিনতেই পারেনা। ঢাকায় এসে তুহিন মা বাবাকে জোর করতে লাগলো মেয়েটির সাথে তুহিনের বিয়ের সম্মতি যেন বাবা মা দেন।
সম্মতি না পেয়ে তুহিন একাই বিয়ে করে নেয় মেয়েটিকে। ঢাকায় আবার ফিরে আসে।আলাদা বাসা নেয়।নতুন সংসার গড়ে।এর মাঝে একটি বারও নীরাকে কল দেয়না তুহিন। নীরা হয়তো নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছিল কিন্তু তুহিনের অবহেলা আর বিয়ের ফিরে আসা চারটি বছর তাকে কখনো স্বস্হিতে থাকতে দিচ্ছিল না।
ডিভোর্সের তিন বছর পর আজ পুরাতন ঘাঁ যেন আবার নতুন হয়ে গেল।ব্যথাটাও প্রচন্ড অনুভূত হচ্ছে।
নীরা তুহিন আর ওর নতুন স্ত্রীর দিক থেকে চোখ সরাতে পারছে না। কিছুক্ষন পর নীরা দেখল তুহিন একটি সি.এন.জি তে মেয়েটিকে উঠিয়ে দিয়ে ক্যাফেটেরিয়ার দিকে এগিয়ে আসছে।
নীরা কি করবে বুঝে ওঠার আগেই তুহিন ক্যাফেটেরিয়ায় ঢুকে কফি অডার করে নীরার পাশের টেবিলে বসতেই চোখ পরল নীরার দিকে।
নীরা চোখ সরিয়ে রাখলেও তুহিন উঠে নীরার সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, "নীরা না? কেমন আছো?"
নীরা ভেতরের ঝড়কে সামলে বলল, "বেশ ভাল। তো তোমার খবর কি? "
তুহিন মাথা নিচু করে বলল, "ভাল।"
কিছুক্ষন চুপ থেকে তুহিন বলল, "কিছু অডার করব?"
নীরার হঠাৎ কি মনে হলো বলল, "খাওয়াবে আমায়?"
তুহিন বলল," অবশ্যই, বল কি খাবে?"
নীরা বলল, " তাহলে অডার ক্যান্সেল কর। বাইরে চল।"
তুহিন নীরার দিকে স্হির চোখে তাকালো। এরপর বাধ্য ছেলের মত অডার ক্যান্সেল করল।
নীরা বাইরে বের হতেই তুহিন নীরাকে অনুসরন করল।
নীরা বলল , "তুমি বাইক নিয়ে এসেছ না?"
তুহিন মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
নীরা বলল, "চল তোমার বাইকে করে রবীন্দ্র সরোবর যাই। ওখানে লুচি আর চিকেন চাপ খাব।আর মাটির হাড়িতে চা খাবো?"
তুহিন আবারো নীরাকে দেখলো। পরে বলল, "চলো।"
বাইকে উঠতেই নীরা ওর চুলগুলো খুলে দিল। সিল্কি লম্বা চুল বাতাসে বারবার তুহিনের শরীরে আছড়ে পরছে। তুহিনের পিঠে জোরে হাতটা চেপে ধরে রাখলো নীরা। তুহিন একবার পেছন ফিরে বাইক চালিয়ে গন্তব্যে ছুটলো।
রবীন্দ্র সরোবরে গিয়ে লুচি আর চাপ খাওয়া হলে মাটির কাপে চা নিয়ে হাঁটতে শুরু করল নীরা। তুহিনও হাটছে। হঠাৎ থেমে বলল,
" এই তুহিন ,গোলাপ গোলাপ। প্লিজ একটা কিনে দাও না।"
তুহিন বিস্ফোরিত চোখে নীরাকে দেখছে। এরপর এক গোঁছা গোলাপ কিনে এনে নীরাকে দিতেই।নীরা একটা গোলাপ তুহিনের হাতে দিয়ে বলল, "কানে গুঁজে দাও তো।"
তুহিন কানে গুঁজে দিল।
নীরা হাঁটছে আর গান গাইছে।হঠাৎ পেছন ফিরে বলল,
"তুহিন তোমার বৌ কি রাগ করবে? তোমার এত সময় নিচ্ছি যে?"
তুহিন বোকার মত মুখ করে বলল, "না না ,ওতো জানবে না। ও আজ চট্টগ্রামে যাচ্ছে বাবার বাড়ি। আমি এমনিতেই ফ্রি।"
নীরা বলল, "তোমার বাবা মা কেমন আছে?"
তুহিন অপরাধীর মত বলল, "জানি না। আসলে ঝুমুর মানে আমার ইয়ে ,ও একদম পছন্দ করে না যে আমি মা বাবার সাথে যোগাযোগ রাখি। "
নীরা জোরে হেসে ফেলল। চুল খোঁপা করে বাঁধার চেষ্টা করতেই,
তুহিন বলল , "খোলা চুলে তোমাকে সুন্দর লাগছে। থাকনা ওভাবে। "
নীরা বলল, ""নৌকায় চড়বো। চলো।"
তুহিন নীরার কথামত নৌকায় বসল। তুহিন বলল, "নীরা তুমি বিয়ে করেছ?"
নীরা বলল," আমাকে কে বিয়ে করবে?"
তুহিন বলল,"কি বলছ আবোল তাবোল তুমি তো সাক্ষাৎ পরী।তোমায় কে বিয়ে করবে মানে?"
নীরা চোখ কুঁচকে তাকালো তুহিনের দিকে। তুহিন চোখ সরিয়ে নিল।
নৌকা থেকে নামতেই নীরা বলল , "তোমার বৌ তো নেই চল মা বাবাকে দেখে আসি।"
তুহিন শিশুদের মত বলল, "যাবে সত্যি। মা বাবা যে কি খুশি হবে!"
নীরা দেখল মোবাইলে বারবার কল আসছে।কখনো মা কখনো বাবার। মোবাইল সুইচ অফ করে তুহিনের সাথে বাইকে উঠে পূর্বের ঠিকানায় এগিয়ে চলল।
তুহিনের বাসায় পৌঁছে যখন তুহিনের মা দরজা খুললেন তিনি যেন ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন। পরক্ষনেই নীরাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। নীরা নিজ হাতে নুডুলস সেমাই রান্না করে দুজনকে খাওয়ালো। নীরার শ্বশুরের স্বাস্হ্য খুব ভেঙে গেছে। তুহিন অসহায়ের মত বসে থাকলো এক কোণায়। ফেরার সময় নীরা প্রমিস করল প্রায়ই দেখতে আসবে উনাদের।
নীরার ফেরার পালা। তুহিন বলল, ঝুমুর না আসা পর্যন্ত সে মা বাবার কাছেই থাকবো।
নীরা আর তুহিন পাশাপাশি নিঃশব্দে হাঁটছে। আকাশে অনেক বড় চাঁদ উঠেছে। তুহিন বলল,
"নীরা , তুমি আমায় নাম ধরে ডেকেছিলে ,খুব ভাল লেগেছিল।"
নীরা মৃদু হাঁসলো।
তুহিন হঠাৎ থেমে গেলো।রাস্তার চারপাশে কোন মানুষ নেই।গম্ভীর কন্ঠে বলল ,"নীরা তোমার হাতটি ধরতে পারি। "
নীরা দুটি হাত বাড়িয়ে দিল। তুহিন কাঁপা হাতে নীরার দুটি হাত চেপে ধরে হু হু করে কেঁদে দিল।
তুহিন ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, "আমি প্রেমিকার খোঁজে সংসার স্ত্রী পরিবার সব হারিয়েছি। পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও।"
নীরার দুটি হাত জলে সিক্ত হচ্ছে। নীরা চাঁদের দিক তাকিয়ে আছে।
কিছুক্ষন পর একটি রিক্সা ডেকে নীরা উঠে পড়ল। পেছনে অশ্রুসিক্ত দুটো চোখ নীরাকে দেখছে।
নীরা মোবাইল সুইস অন করতেই শিশিরের কল। শিশিররা নীরাদের পাশের ফ্ল্যাটে উঠেছে দুই বছর হয় । নীরার বাবা মায়ের খুব পছন্দের ছেলে। প্রচন্ড হাস্যোজ্জ্বল মানুষ। আকারে ইংগিতে নীরাকে অনেকবার বলেছে যে সে নীরাকে পছন্দ করে।কিন্তু নীরা এক মোহের স্রোতে প্রতিনিয়ত ভেসে যেতো বারবার।
আজ তার মুক্তি। সমস্ত কষ্ট, গ্লানি অন্য কাউকে দিয়ে সে আজ নিঃস্ব। পাখির পালকের মত আজ হালকা লাগছে।
শিশিরের কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে অধিকার ভরা কন্ঠ বলে উঠল,
"কি ব্যাপার, আন্টি আংকেল কত চিন্তিত।আর আপনি কোথায়?"
নীরা বলল," তুমিতো আমার থেকে চার বছরের বড়।তুমি আমায় তুমি ডাকতে পারো না?"
ওপাশে কেবল নিঃশ্বাসের শব্দ।
নীরা বলল," মা বাবাকে বল সারারাত তুমি আর আমি জোৎস্না দেখবো।আমি বাসার নিচে আছি।"
শিশির বলল, "দশ মিনিট সময় হবে।মানে একটু গুছিয়ে......."
নীরা বলল, "হবে........"
নীরা আকাশের দিকে তাকায়। জোৎস্না এতসুন্দর হয় ওর আগে জানা ছিল না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন